চীন সীমান্তে নজিরবিহীন সেনাসংখ্যা বাড়িয়েছে ভারত। অরুণাচল প্রদেশের সীমান্ত এলাকায় দুই দেশের সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষের কয়েক দিনের মাথায় এ কথা জানান ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। অন্যদিকে ভারতের অরুণাচল সীমান্তে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে চীন। এমনটাই দাবি করেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি।
সম্প্রতি অরুণাচল প্রদেশের সীমান্ত এলাকায় সংঘাতে জড়ায় ভারত ও চীনের সেনারা। এ ঘটনায় উভয় পক্ষের বেশ কয়েকজন সেনা সদস্য আহত হয়েছেন বলে খবর বের হয়। এর পর থেকেই সীমান্তে উত্তেজনা বিরাজ করছে।
সীমান্তে ভারতীয় সেনাদের সংযত আচরণ করার জন্য চীনের পক্ষ থেকে ভারতকে সতর্ক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে রুশ গণমাধ্যম আরটি।
কেন মুখোমুখি চীন-ভারত?
ভারত ও চীনের মধ্যে ৩ হাজার ৪৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ বিরোধপূর্ণ সীমান্ত রয়েছে। হিমালয় সীমান্ত নিয়ে ১৯৬২ সালে যুদ্ধে জড়ায় ভারত ও চীন। সেই যুদ্ধে লজ্জাজনক হার হয় নয়াদিল্লির। তবে সীমান্তে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বা ডি ফ্যাক্টো সীমানা গঠনের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে সেই সংঘাতের অবসান হয়। সীমান্তের বিরোধপূর্ণ যে এলাকা তাকে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বা লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলএসিও) বলা হয়।
পার্বত্য অঞ্চলে অসংখ্য নদী, হ্রদের অবস্থান পাশাপাশি তুষার আবৃত পর্বতের কারণে এই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা প্রায়ই পরিবর্তিত হয়ে যায়। আর তখন বেশ কিছু পয়েন্টেই বিশ্বের দুই বৃহত্তম সেনাবাহিনীর সদস্যরা মুখোমুখি অবস্থান নেয়। এখন পর্যন্ত সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে ভারত ও চীনের সেনারা বেশ কয়েকবার সংঘর্ষে জড়িয়েছে। সাম্প্রতিক বড় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে ২০২০ সালে। সে বছরের জুনে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় চীনা-নিয়ন্ত্রিত তিব্বতে ভারতীয় ও চীনা সৈন্যদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সীমান্তে চীনা সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষে ভারতের সামরিক বাহিনীর অন্তত ২০ সেনা নিহত হয় বলে স্বীকার করে নয়াদিল্লি। যদিও চীন ওই সংঘাতের ঘটনায় হতাহতের কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি। তবে ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমের দাবি, চীনের ৪০ জনের বেশি সেনা নিহত হয়।
কতটা ভয়াবহ বর্তমান পরিস্থিতি?
সবশেষ ৯ ডিসেম্বর অরুণাচলের তাওয়াং সীমান্তে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে বেশ কয়েক জন সেনা আহত হয়েছেন। এ ঘটনার পর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ১৯ ডিসেম্বর সংবাদমাধ্যমকে জানান, চীনের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ সীমান্ত এলাকায় নজিরবিহীন মাত্রায় সেনা মোতায়েন বাড়িয়েছে তার দেশ। সীমান্ত অঞ্চলের স্থিতাবস্থা চীনকে একতরফাভাবে পরিবর্তন করতে দেয়া হবে না বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও শরগোল চলছে। এ বিয়ে আলোচনায় অস্বীকৃতি জানানোয় বিরোধী দল সংসদ থেকে ওয়াকআউট করে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর অভিযোগ, মোদি সরকার চীনের হুমকি পাত্তা দিচ্ছে না বলেই সীমান্তে চীনের সেনারা ভারতীয় সেনাদের মারধর করছে। এ বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর ১৯ ডিসেম্বর সংসদে বলেন, রাহুল গান্ধীর বক্তব্য ভারতীয় সৈন্যদের অসম্মান করেছে। এ পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের উদাসীন থাকার অভিযোগও অস্বীকার করেন তিনি।
নতুন করে উত্তেজনা কেন?
একে তো বিরোধপূর্ণ অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা, তার ওপর সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক মহড়া চালিয়েছে ভারত। ভারত-মার্কিন যৌথ মহড়ার প্রভাবেই নতুন করে এ উত্তেজনা বলেও মনে করছেন অনেকে।
মার্কিন গণমাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, চীন সীমান্তে গেল মাসে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর যৌথ সামরিক মহড়ার পর থেকেই চীনের সঙ্গে উত্তেজনা শুরু হয়। ‘যুদ্ধ অভ্যাস’ নামে এই সামরিক মহড়া প্রতিবছর হলেও এবার চীন সীমান্ত থেকে মাত্র ৬৫ মাইল দূরে অনুষ্ঠিত হয় এটি। আর এতেই ক্ষিপ্ত হয় চীন। সে সময় এ মহড়াকে চীন ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত অঞ্চলে পারস্পরিক আস্থার পরিপন্থি বলেও মন্তব্য করে বেইজিং। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র যৌথ মহড়া অরুণাচল প্রদেশে সীমান্ত সংঘাতের সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে পারে বলেও জানায় দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট।
আরও পড়ুন: ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা ভারতের, আঘাত হানতে পারবে বেইজিংয়ে
যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে চীন
সাম্প্রতিক উত্তেজনার জেরে এরই মধ্যে চীন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে বলে দাবি করেছে এনডিটিভি। গণমাধ্যমটির দাবি, ম্যাক্সার স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া চিত্রে অরুণাচলের প্রতিবেশী তিব্বতের একটি বিমানঘাঁটিতে চীন বিপুলসংখ্যক ড্রোন এবং যুদ্ধবিমান মজুত করতে দেখা গেছে।
গণমাধ্যমটির দাবি, চীনের সশস্ত্র বাহিনী তিব্বতের বাগডা বিমানঘাঁটিতে ডব্লিউজেড-৭ মডেলের ‘উড়ন্ত ড্রাগন’ নামে বেশ কয়েকটি ড্রোন মজুত করেছে। ২০২১ সালে চীন এ ড্রোনগুলো প্রথম ব্যবহার করতে শুরু করে। এগুলোর বিশেষত্ব হলো, টানা ১০ ঘণ্টা উড়তে পারে। ড্রোনগুলো নজরদারি এবং তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম। এমনকি প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট অবস্থানে থাকা ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রকে হামলার নির্দেশও দিতে পারে ড্রোনগুলো।
যা বলছে চীন
যুদ্ধের প্রস্তুতির বিষয়ে চীনের পক্ষ থেকে কোনো কিছু জানানো না হলেও নয়াদিল্লিকে সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় সেনাদের নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি তাদের সংযত আচরণ করার আহ্বান জানিয়েছে বেইজিং।
কী চায় চীন ও ভারত?
চীন ও ভারত দুদেশই বিতর্কিত সীমান্ত অঞ্চলে ব্যাপকভাবে সামরিকীকরণের মাধ্যমে মূল ভূখণ্ডে তাদের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। দুদেশই রাস্তাঘাট, আকাশপথ, আউটপোস্ট স্টেশন এবং টেলিফোন লাইনসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করছে। বিতর্কিত সীমান্তে সেনারা নিয়মিত টহল চালাচ্ছে। চীন হিমালয়ের পূর্বাঞ্চলের ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার এবং পশ্চিমে আরও ৩৮ হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকা দাবি করে আসছে। অন্যদিকে ওই অংশ নিজেদের দাবি করে ভারতও ছাড় দিতে রাজি নয়।