শেখ রেহানা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ছোট মেয়ে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ গুলি করে হত্যা করা হয়। শেখ রেহানা বড় বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে দেশের বাইরে থাকায় রক্তাক্ত অভ্যুত্থান থেকে সেদিন বেঁচে গিয়েছিলেন।
ইতিহাসের এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের পর কিশোরী রেহানা তার মৃত্যু কামনা করেছিলেন। হত্যাকাণ্ডের কয়েক বছর পর এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘১৫ আগস্ট আমি মরে গেলেই ভালো হতো। বাবা নেই, মা নেই, ভাই নেই। আমার আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না। আমি কী নিয়ে বাঁচব? কী আছে আমার? রাসেল কী অপরাধ করেছিল? ও তো রাজনীতি করত না। আমার মা তো রাজনীতি করত না। কেন ওরা তাদের হত্যা করল?’
শেখ রেহানা বলেন, ‘সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা, আমার মতো যেন কাউকে তিনি শাস্তি না দেন। আমি এতিম বড় অসহায়। আমি মেয়ে হিসেবে, বাঙালি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার চাই।’
শেখ রেহানা সাধারণ মানুষের মতোই জীবনযাপন করেন। কখনো তিনি অহংকার করেন না। নীরবে-নিভৃতে দেশের জন্য কাজ করেন। বড় বোন শেখ হাসিনাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছেন।
রেহানা কখনো রাজনীতিতে শামিল হওয়ার কথা ভাবেননি; কিন্তু নেপথ্যে বড় বোনকে সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। ইতিহাসবিদদের বর্ণনানুযায়ী, রেহানা একজন আদর্শ বোন, বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য পূরণের লক্ষ্যে নিঃস্বার্থ সমর্থনের উৎস। দুই বোন জন্মসূত্রে বন্ধনে আবদ্ধ এবং তারা অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন।
হাসিনা বলেন, তার ছোট বোন অনেকটা মায়ের মতো সংগঠিত ও সুশৃঙ্খল। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কাছে রেহানা ‘ছোট আপা’ হিসেবেই পরিচিত।
রেহানা তার পৈতৃক টুঙ্গিপাড়া গ্রামের জীবনকে মিস করেন। পূর্ণদৈর্ঘ্য ‘হাসিনা: এ ডটার’স টেল’ প্রামাণ্যচিত্রে এর প্রতিফলন রয়েছে। পঁচাত্তর ট্র্যাজেডির পর বড় বোন শেখ হাসিনার মতো শেখ রেহানার জীবনেও ঝড় বয়ে যায়, সেই দুঃসময় সামলে উঠে চলছেন তিনি জীবনের পথে।
অভ্যুত্থানের আগে শেখ হাসিনাসহ বেলজিয়ামে উড়াল না দিলে বাবা-মা ও ভাইদের মতো তাকেও হত্যা করা হতো। তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে শেখ হাসিনা ও রেহানার জন্য জীবন কখনোই সহজ ছিল না।
হত্যাকাণ্ডের সময় তারা বেলজিয়ামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের বাসায় ছিলেন। অভ্যুত্থানের খবর ছড়িয়ে পড়লে রাষ্ট্রদূত তাদের কোনো ধরনের সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানান। এমনকি বিমানবন্দরে যেতে গাড়ি দিতেও অস্বীকৃতি জানান। পরে দু-বোন জার্মানি হয়ে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে চলে যান। সেখানে তাদের নির্বাসিত জীবনের দীর্ঘ একটা সময় কাটে।
শেখ রেহানা পরে ভারত থেকে লন্ডনে চলে যান এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। লন্ডনে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন শেখ রেহানা। দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হয়েও কখনো রাজনীতিতে আসেননি শেখ রেহানা। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ সক্রিয় রাজনীতিবিদদের অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা দিয়ে গেছেন সবসময়।
এসব আন্দোলন-সংগ্রাম এবং আওয়ামী লীগের প্রতিটি সংকটে বড় বোন শেখ হাসিনার পাশে থেকে সহযোগিতা করে গেছেন শেখ রেহানা। দেশ ও জাতির কল্যাণে অনেকটা নেপথ্যে থেকেই ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর এই কনিষ্ঠ কন্যা। জনহিতৈষী কাজেও সবৎসময়ই ভূমিকা রয়েছে শেখ রেহানার। মানবিক হৃদয়ের জন্য মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন তিনি। যিনি সাধারণ হয়েও অসাধারণ।
তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও হুমকি এখনও থামেনি। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরার পর থেকেই স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। সে বছরই তার ওপর হামলা চালায় বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের সংগঠন ফ্রিডম পার্টির সন্ত্রাসীরা।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে চালানো সবচেয়ে বড় হামলায় ২৪ জন নিহত ও কমপক্ষে ৪০০ জন আহত হন। যড়যন্ত্রকারীরা আরেকটি ১৫ আগস্ট ঘটাতে চেয়েছিল সেদিন।
২১ আগস্ট রেহানা শেখ হাসিনার সঙ্গে সেই সমাবেশে যোগ দিতে চেয়েছিলেন। তবে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী হাসিনা তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন।
শেখ রেহানা বলেন, “‘আমি খুব অনুরোধ করলাম আপাকে–আপা, আমি যাই তোমার সঙ্গে আজকে।’ উনি বললেন, ‘না, তুমি বাসায় থাকো, তোমার যেতে হবে না।’
আমি তখন অভিমান করে, খুব রাগ করে ছোটবেলার মতোই দুমদাম করে ঘরের ভেতর চলে গেলাম।” এর মধ্যে বাসায় কয়েকজন মেহমান আসেন জানিয়ে শেখ রেহানা বলেন, “আপা বললেন, ‘ওনাদের তুমি চা-নাশতা খাওয়াও, গল্প করো, আমি এখনই আসব।’”
মেহমানদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই টেলিভিশনে সমাবেশে হামলার খবর পান শেখ রেহানা। ‘ওই ঘটনা দেখে আমি (বাসার) নিচে চলে আসি। এর মধ্যে খবর আসছে যে আপা (শেখ হাসিনা) নেই।’
রেহানা বলেন, ‘এর মধ্যে আপার গাড়িটা সুধা সদনে এলো, এসে দাঁড়াল। আমি সেখানে দাঁড়ানো। দেখলাম আপার সমস্ত শরীরে, শাড়িতে, মুখে, চোখে রক্ত ভরা। আমি আস্তে আমার আঁচলটা দিয়ে এগুলো মুছে আপাকে ধরে ভেতরে আনলাম।’
২০০৪ সালের একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার প্রথম কিংবা শেষ চেষ্টা নয়, এর আগেপরে হত্যার উদ্দেশ্যে তার ওপর ১৫ বার সশস্ত্র হামলা হয়েছে। ষড়যন্ত্র হয়েছে আরও অন্তত পাঁচবার। শেখ রেহানা যেহেতু শেখ হাসিনার নিত্যসঙ্গী, তাই তিনিও তার বোনের মতোই হুমকিতে রয়েছেন।
নানান হুমকি তাড়া করলেও শেখ রেহানা তার সন্তানদের ভালো মানুষ হিসেবে তৈরি করতে সহায়তা করে গেছেন।
রেহানা একজন গর্বিত মা। সততার অনুকরণীয় আদর্শ এক রত্নগর্ভা মা তিনি। অধ্যাপক ড. শফিক আহমেদ সিদ্দিক ও শেখ রেহানা দম্পতির তিন ছেলেমেয়ে। তাদের মধ্যে বড় মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটিশ পার্লামেন্টে লেবার পার্টির একজন এমপি। ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত এবং আওয়ামী লীগের গবেষণা উইং সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) ট্রাস্টি।
ছোট মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তী লন্ডনে ‘কন্ট্রোল রিস্কস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের গ্লোবাল রিস্ক অ্যানালাইসিস সম্পাদক হিসেবে কর্মরত।
বঙ্গবন্ধুর যে উত্তরাধিকারকে ঘাতকরা নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল, সেই শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছাই থেকে ফিনিক্স পাখির মতো উঠে এসেছেন। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার মানুষের কল্যাণে তার দুই কন্যার এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক।