বিভিন্ন মহাদেশ ও পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক সৃষ্টি নিয়ে মানুষের কৌতুহলের শেষ নেই। বিজ্ঞানীরাও মহাদেশ ও পৃথিবী সৃষ্টি নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন গবেষণা।
সাড়ে চারশো কোটি বছর আগে সৃষ্টি হওয়া এ পৃথিবী শুরুতেই আজকের ভৌগলিক ম্যাপ পেয়ে গেছে এমন নয়। সৃষ্টির প্রথম দিকে অথৈ জলোসমুদ্রে খুব কমই স্থলভাগ ছিল, অনেকটা ছোট ছোট দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্নভাবে। এসবের আগ্নেয়গিরি থেকে ক্রমাগত লাভা নির্গত হতো। লাভা আর টেকটোনিক প্লেটের নড়ন-চড়নে ক্রমান্বয়ে বিস্তৃত হতে থাকে স্থলভাগ। মজার ব্যাপার হলো, একটা সময় মহাদেশ ছিল একটিই যেটা সময়ের সাথে বিবর্তন হয়ে এখনকার রূপে এসেছে। বলেছেন জার্মান বিজ্ঞানী আলফ্রেড ওয়েগেনার। আর সেই ‘এক মহাদেশ’র নাম দিয়েছিলেন ‘প্যানজিয়া’। প্রশ্ন হচ্ছে, কেমন ছিল সেই এক মহাদেশ প্যানজিয়া? কেন, কিভাবে এটি বিভক্ত হয়ে আলাদা আলাদা আলাদা মহাদেশের সৃষ্টি হয়েছে?
৪.৫ বিলিয়ন বছর অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৪ শ’ কোটি বছর আগে সূর্য থেকে পৃথিবী সৃষ্টি হয়। চাঁদ সৃষ্ট হয় পৃথিবীর সাথে মঙ্গল-সাইজের একটা গ্রহ থিয়া’র সংঘর্ষের মাধ্যমে। অভিকর্ষজ বলের কারণে ভারি পদার্থগুলো পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে এসে জমা হতে থাকে, অন্যদিকে অক্সিজেন, সিলিকনের মত হালকা পদার্থগুলো ওপরে উঠে আসে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভূমি কিভাবে তৈরি হয়েছে? এই ভূমি তৈরির জন্য ধূমকেতু ও পৃথিবীর চারপাশে যে গ্রহাণুপুঞ্জ রয়েছে সেগুলোর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, পৃথিবীর গঠনের শুরুর দিকে ধূমকেতু ও গ্রহাণুপুঞ্জের আঘাতেই ভূমি তৈরি ত্বরান্বিত হয়। শুধু তাই নয়, বিজ্ঞানীদের মতে, প্রাণ সৃষ্টির জন্য দরকারি হাইড্রোকার্বন কিংবা কার্বনভিত্তিক জৈব যৌগও ধূমকেতু থেকেই এসেছে। যেহেতু সূর্য থেকে পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে, তাই সৃষ্টির শুরুতে এই গ্রহ বেশ উত্তপ্ত থাকলেও ধীরে ধীরে তা শীতল হতে থাকে। এই প্রক্রিয়াটি এক দুই বছরের নয়, মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে চলেছে। গলিত লাভার শীতল-কঠিন অবস্থাই পৃথিবীর প্রথম ভূমি। প্রাথমিক দিকের ভূমি উপাদান হল গ্রানাইট। এই গ্রানাইট পানি আর নানা খনিজ পদার্থের সাথে বিক্রিয়ায় রাসায়নিকভাবে পরিবর্তিত হয়ে যে ভূমিরূপ ধারণ করে, এর নাম ক্রিগটন, আর এটিই হলো মহাদেশের শৈশবিক অবস্থা।
প্যানজিয়া অথবা এর বিচ্যুতির কথা বললে প্রথমেই যে শব্দটি চলে আসে, সেটি হল ‘টেকটোনিক প্লেট’। প্রায় ৩ বিলিয়ন বছর আগে টেকটোনিক প্লেট তৈরি হয়, ভূগর্ভস্থ ম্যাগমা ও খনিজ পদার্থ নিয়ে। পৃথিবীর লিথোস্ফিয়ার স্তরে এর অবস্থান, আরো স্পষ্ট করলে, টেকটোনিক প্লেট নিয়েই লিথোস্ফিয়ার গঠিত। এর সুনির্দিষ্ট কোন আকার নেই, দৈর্ঘ্যে ১৫ থেকে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। পুরো পৃথিবীর টেকটোনিক প্লেটকে প্রধানত সাত-আট ভাগে ভাগ করা হয়। এছাড়াও অসংখ্য ছোট-ছোট প্লেট আছে। প্লেটগুলো চলমান, খুবই ধীরগতিতে; বছরে সর্বোচ্চ ১০০ মিলিমিটারের মত। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এই টেকটোনিক প্লেটের এতটুকু নড়াচড়াতেই কিন্তু উপরে প্রলয়ঙ্করী সুনামি, ভূমিকম্প ঘটে যায়!
বিজ্ঞানী ওয়েগনারের মতে ইন্ডিয়া, সাউথ আমেরিকা, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও অ্যান্টার্কটিকা একসঙ্গে জড়ো হয়ে গন্ডোয়ানাল্যান্ড গঠন করে। অন্যদিকে, নর্দান আমেরিকা, ইউরোপ, নর্থ ও মিড এশিয়া লরেশিয়ার অন্তর্ভূক্ত। এই দুই ভূখন্ড গন্ডোয়ানাল্যান্ড ও লরেশিয়া মিলে যে সুবিশাল স্থলভাগ গঠন করেছিল সেটির নামই প্যানজিয়া। ৩৫০ মিলিয়ন বছর আগে সৃষ্ট এই প্যানজিয়াই হল বর্তমানকালের দৃশ্যমান মহাদেশগুলোর আদি-অকৃত্রিম রূপ। আলফ্রেড ওয়েগনার এই প্যানজিয়াকে ঘিরে থাকা বিশাল জলভাগের নামকরণ করেছিলেন প্যানথালাসা।
মূলত টেকটোনিক প্লেটের মুভমেন্টের কারণেই প্যানজিয়া বিভক্ত হয়ে অসংখ্য স্থলভাগের সৃষ্টি হয়। তবে এ ঘটনা একদিনে হয়নি। ২৫০ মিলিয়ন বছর আগে যখন প্যানজিয়ার ভাঙন শুরু হয় তখন পৃথিবীতে নেমে আসে এক মহাবিপর্যয়, পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রাণিবৈচিত্র্যের বিলুপ্তিও ঘটে সেসময়। এ বিপর্যয়ে তখনকার প্রায় নব্বই শতাংশ প্রাণিই বিলুপ্ত হয়ে যায়! প্রাণিজগতে দেখা যায় উল্লেখযোগ্য বিবর্তন।
এভাবে শত কোটি বছর ধরে মহাদেশীয় ভাঙাচোরার মধ্য দিয়েই চলছে পৃথিবী। আর এই বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করার জন্য ১৯১২ সালে ওয়েগনার continental drift theory বা মহাদেশীয় বিচ্যুতির ধারণা দেন। এই থিওরি অনুসারে, পৃথিবীর ভূ-ভাগগুলো ভাসমান অবস্থায় রয়েছে এবং এগুলো ক্রমে পরস্পর যুক্ত বা বিযুক্ত হচ্ছে। এই মহাদেশীয় বিচ্যুতিরই ফসল হিমালয়, আল্পস পর্বতমালা, গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের মত গিরিখাত। ফ্রান্স, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, স্লোভেনিয়া থেকে শুরু করে বিস্তৃত আল্পস পর্বতমালা, এসবকিছুই আফ্রিকান ও ইউরোপের টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষে তৈরি। এর ফলে সৃষ্ট গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন যেন একটি টাইম মেশিন! এর পরতে পরতে রয়েছে কালের বিবর্তনের সাক্ষ্য!
উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার সংযোগকারী পাথুরে অঞ্চলটি ১৭ মিলিয়ন বছরে গঠিত হয়। যার ফলে পৃথিবীর জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে পানির মুক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়। দুই অঞ্চলের ভৌগলিক পরিবেশ ও জীবকুলের মাঝে পার্থক্য গড়তে থাকে। দর্শক, এই ভৌগলিক বিবর্তন কিন্তু থেমে নেই, নিশ্চল নেই টেকটোনিক প্লেট। একটা সুনামি, সিডরই প্রকৃতির কাছে মানুষের অসহায়ত্ব বুঝিয়ে দেয়।
কন্টিনেন্টাল ড্রিফট থিওরি মতে, ভূখণ্ডগুলো তো সম্প্রসারিত হয়েই চলছে। আবার পৃথিবী হচ্ছে গোল, সমতল নয়। যে কয়েকটি জায়গা থেকে মহাদেশীয় বিচ্যুতি লক্ষ্য করা যায়, এর মধ্যে আইসল্যান্ড অন্যতম। উত্তর আমেরিকান ও ইউরেশীয় প্লেট ঠিক আইসল্যান্ডের মাঝে অবস্থিত। জিপিএস’র মাধ্যমে ঐ জায়গার অবস্থান মেপে দেখা গেছে, উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ আড়াই সেন্টিমিটার করে একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি বছরে প্রায় এক ইঞ্চি করে! এক শতাব্দী পর ইউরোপ এবং আমেরিকা পরস্পর থেকে ৮ ফুট দূরে সরে যাবে!
যেভাবে মহাদেশীয় বিচ্যুতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এমন করে যদি মহাদেশগুলো সঞ্চারিত হতেই থাকে তবে শেষ পরিণতিটা কি হবে কখনও ভেবে দেখেছেন? পৃথিবী যেহেতু গোলাকার তাই যদি এক দিক থেকে প্রসারণ শুরু হয় তাহলে লক্ষ লক্ষ বছর পর প্রসারিত হতে হতে ঠিক বিপরীত দিকে গিয়ে আবার মিলিত হওয়ার কথা। এক পৃষ্ঠে শুরু হলে অপর পৃষ্ঠে মিলিত হতেই হবে, নয়তো আর কোথায়ই বা সঞ্চারিত হবে? কন্টিনেন্টাল ড্রিফট জিনিসটাই এরকম, এটি যুগের পর যুগ চলতেই থাকে। এক সময় ভারত অস্ট্রেলিয়া আফ্রিকা একসাথে ছিল এবং এক সময় আবার দূরে সরে গেছে। আবার একটা সময় আসবে যখন পুনরায় ভারত অন্য অংশের সাথে মিলিত হবে। তবে প্রথম বার যে পৃষ্ঠে মিলিত ছিল পরের বার মিলিত হবে ঠিক তার বিপরীত পৃষ্ঠে। একত্রে মেশার পর আবার বসে থাকবে না, পুনরায় আবার সঞ্চারণ শুরু করবে। এভাবে চলতেই থাকবে।
পুরো ব্যাপারটা হলো, যেহেতু পৃথিবী গোল এবং সসীম তাই এক দিক থেকে মহাদেশীয় প্লেটের মাঝে দূরত্ব বৃদ্ধি পেলে অন্য দিক দিয়ে দূরত্ব কমে আসে। যেমন, আমেরিকা আর আফ্রিকা পরস্পর থেকে দূরে সরে যাবার ফলে আটলান্টিক মহাসাগর ক্রমে ক্রমে আকারে বড় হয়েই চলছে, আবার অন্যদিকে আমেরিকা যেদিক দিয়ে সরে যাচ্ছে সেদিক দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগর ক্রমে সংকুচিত হয়ে আসছে। আগে কোনো কোনো জায়গা উঁচু ছিল এখন নিচু হয়ে গেছে আবার কোনো জায়গা নিচু ছিল এখন উঁচু হয়ে গেছে। কেও কেও সাগরের তলায় ছিল এখন পানির উপরে আবার কোনো এলাকা স্থলভাগ হিসেবে ছিল এখন সাগরের তলায়। এরকম করে যে দুটি স্থান একসাথে ছিল তা এখন দূরে চলে গেছে, আবার যে দুটি স্থান দূরে ছিল তা এখন একসাথে! এ যেন প্রকৃতির অপরূপ পেন্ডুলাম, যা একবার একদিকে যাবার পর পুনরায় আগের জায়গায় ফিরে আসে। তাই যে প্যানজিয়া বিভক্ত হয়ে এতো মহাদেশের সৃষ্টি হয়েছে, কে জানে হয়তো একদিন আবার সেগুলো এক হয়েও যেতে পারে!
বাংলাদেশ সময়: ১৫:১৩:২৮ ২০৫ বার পঠিত