মোস্তাফিজার রহমান রংপুর প্রতিনিধি : সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সৈনিক, নিবেদিত সাংস্কৃতিক সংগঠক, সাংবাদিক ও ছড়াকার প্রয়াত মানিক সরকার মানিককে ফুলেল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বিদায় জানিয়েছে রংপুরের সর্বস্তরের মানুষ। মঙ্গলবার (৩ জানুয়ারি) দুপুর সোয়া ২টায় সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তার মরদেহ রংপুর প্রেস ক্লাব চত্বরে আনা হয়।
সেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, স্বেচ্ছাসেবী, পেশাজীবী ও ব্যবসায়ী সংগঠনসহ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এই গুণী সাংবাদিক ও সংগঠনের মৃত্যুতে সবাই ছুটে এসেছিলেন শেষবারের মতো বিদায় জানাতে।
সেখানে রংপুর সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা, রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক এ কে এম ছায়াদত হোসেন বকুল ও যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক মাজেদ আলী বাবলু, মহানগরের আহ্বায়ক ডা. দেলোয়ার হোসেন ও যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল কাশেম, সাবেক পৌর চেয়ারম্যান কাজী মো. জুননুনসহ জাতীয় পার্টি, জাসদ, বাসদ, ছাত্রলীগ, রংপুর প্রেস ক্লাব, সিটি প্রেস ক্লাব, রিপোর্টার্স ক্লাব, রিপোর্টার্স ইউনিটি, মাহিগঞ্জ প্রেস ক্লাব, বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, টিভি-ক্যামেরা জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনসহ (টিসিএ) বিভিন্ন সংগঠনের সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ ও সহকর্মীরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এছাড়া আরও শ্রদ্ধা জানায় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, বিভাগীয় লেখক পরিষদ, বাংলার চোখ, পদাতিক, কালীবাড়ি মন্দির কমিটি, রাধাগোবিন্দ মন্দির কমিটি, পূজা উদযাপন পরিষদসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী ও ব্যবসায়ী সংগঠনসহ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। প্রেস ক্লাব চত্বরে বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মী ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন মানিক সরকার মানিকের পরিবারের সদস্য ও তার সহযোদ্ধারা।
এসময় পরিবারের পক্ষে সাংবাদিক মানিক সরকার মানিকের একমাত্র সন্তান শুভায়ু সরকার কাব্য বলেন, আমার বাবা তার লেখনির মাধ্যমে রংপুরের মানুষের জন্য কাজ করেছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রংপুরের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে সুস্থ ধারার চর্চা এবং সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করতে তিনি অপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ করে অধিকার আদায়ের সংগ্রামেও তিনি ভূমিকা রেখেছেন। তার মৃত্যুতে আমি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলাম। ভালোবাসা, স্নেহ বঞ্চিত হয়ে গেলাম।
এছাড়া আরও বক্তব্য দেন রংপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতি মাহবুব রহমান ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বাপ্পী।
প্রেস ক্লাব চত্বরে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন শেষে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় গুপ্তপাড়ার বাসভবনে। সেখানে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নেতৃবৃন্দ ছাড়াও বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। পরে বিকেল ৪টায় মরদেহ নগরীর দখিগঞ্জ মহাশ্মশানে নিয়ে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়।
এর আগে মঙ্গলবার ভোর ৬টার দিকে রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান রংপুরের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও ছড়াকার মানিক সরকার মানিক। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫৮ বছর। তিনি ১৯৬৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রংপুর নগরীর সেনপাড়া চাউল আমোদ এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা প্রমথ রঞ্জন সরকার ও দেবী রাণী সরকার।
সাংবাদিক মানিক সরকার মানিক নগরীর গুপ্তপাড়ার এসএম চক্রবর্তী সড়কে নিজ বাসভবনে স্ত্রী মাধুরী সরকারকে নিয়ে বসবাস করতেন। তার একমাত্র সন্তান শুভায়ু সরকার কাব্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন।
বহুমুখী প্রতিভায় রংপুরের সাংস্কৃতিক ও সাংবাদিকতা অঙ্গনে আলো ছড়ানো মানিক সরকার মানিকের সর্বশেষ কর্মস্থল দৈনিক জাগরণ (অনলাইন) ও স্থানীয় দৈনিক পরিবেশ। তিনি দৈনিক জাগরণ পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার এবং দৈনিক পরিবেশে উপ-সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
মূলত স্কুলজীবন থেকেই লেখালেখিতে হাতেখড়ি তার। ১৯৭৯ সালে প্রথম তার লেখা পত্রিকায় ছাপা হয়। এরপর ১৯৮৬ সাল থেকে ৯০ সাল পর্যন্ত ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক স্বদেশ খবর, সাপ্তাহিক পূর্বানী, সাপ্তাহিক খবরের কাগজ এবং একই সময়ে রংপুরের দৈনিক দাবানলে ‘প্রবাহ’ শিরোনামে নিয়মিত কলাম লিখতেন। ১৯৯১ সালে দৈনিক রূপালীতে নিজস্ব সংবাদদাতা এবং পরবর্তীতে স্টাফ রিপোর্টার ও রংপুর ব্যুরো চিফ মনোনীত হন। এরপর ১৯৯৩ সালে প্রথমে নিজস্ব সংবাদদাতা হিসেবে দৈনিক জনকণ্ঠে যোগ দেন। পরবর্তীতে ২০০২ সালে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে পদোন্নতি পান এবং ২০১০ পর্যন্ত ১৮ বছর কাজ করেন।
এর আগে ২০০৯ সালের আগস্ট মাসে দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার এবং রংপুর অফিস প্রধান হিসেবে যোগ দিয়ে ২০১২ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত কাজ করেন। এরপর ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি আবারো স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে জনকণ্ঠে যোগ দেন। পাশাপাশি তিনি চ্যানেল নাইনে এক বছর কাজ করেন। পরে চ্যানেল নাইন ছেড়ে ২০১৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে সময় টেলিভিশনে স্টাফ রিপোর্টার এবং রংপুর ব্যুরো ইনচার্জ হিসেবে যোগ দেন।
সময় টেলিভিশনের পাশপাশি তিনি কিছুদিন দৈনিক ইত্তেফাকেও কাজ করেন। ২০১৮ সালে শারীরিক অসুস্থতার কারণে সময় টেলিভিশন ছেড়ে দেন। এরপর থেকে দৈনিক জাগরণ ও দৈনিক পরিবেশে কর্মরত ছিলেন।
তিনি পাঁচবার রংপুর প্রেস ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। মানিক রংপুরের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে নিবেদিত হয়ে কাজ করেছেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। শুধু তাই নয় সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি নিয়মিত ছড়াও লিখতেন। মানিক সরকার মানিক রংপুরের রাজপথে স্বৈরাচার পতন আন্দোলন ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনে সম্মুখে থেকে লড়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ২১:০২:৫২ ২৯৩ বার পঠিত