বৈশ্বিক খাদ্যসংকটের ঝুঁকির কথা বলা হলেও কৃষিতে অভাবনীয় সফলতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্ব ব্যাংকও বলেছে, বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতি হয়নি। ফলে সুবিধাজনক অবস্থায়ই ক্ষমতার তৃতীয় মেয়াদের পঞ্চম বছরে পা রেখেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
এক সময় বলা হতো, পৃথিবীতে জনসংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে, আর খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ছে গাণিতিক হারে। অতএব, পৃথিবীতে খাদ্যাভাব হবে, দুর্যোগ দেখা দেবে - এ ধারণার উদ্ভব ঘটিয়েছিলেন থমাস ম্যালথাস।
কিন্তু এ চিন্তার বিপরীতেও কথা বলেছেন বিজ্ঞানীরা। তারা জানান, কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির প্রভাব উৎপাদনকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেবে। জনসংখ্যা বাড়লেও খাদ্য উৎপাদন বাড়ার কারণে কোনো অসুবিধায় পড়তে হবে না। এখন তা সঠিক প্রমাণিত হয়েছে।
যে কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর আবাদি জমি কমে গেলেও বিপরীতে উৎপাদন বাড়ছে কয়েকগুণ হারে। ফলে যুদ্ধ-মহামারিতে কোনো খাদ্যঘাটতির শঙ্কা দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা।
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব বলাই কৃষ্ণ হাজরা সময় সংবাদকে বলেন, ‘আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে দাবি করতে পারি। আমাদের জনগোষ্ঠীর খাদ্যচাহিদা আমরা মেটাতে পারব। কোনো ঘাটতি দেখা দেবে না।’
তিনি জানান, ‘খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলছি এ ধারণা থেকে যে, আমাদের প্রায় ৩৭ লাখ গরু রয়েছে। জনসংখ্যার তুলনায় যা যথেষ্ট। আর বিশ্বের মাছ উৎপাদন বাড়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয়তে রয়েছে বাংলাদেশ। আমাদের গবাদিপশুর জন্য দেড় থেকে দুই কোটি মেট্রিক টন দানাদার খাদ্যশস্য লাগে। সে কথা বিবেচনা করলে বিপুল এ পরিমাণ গবাদিপশু ও মানুষের খাবারের পুরোটাই আমরা উৎপাদন করছি।’
১৯৭২ সালে এ দেশে খাদ্যশস্যের মোট উৎপাদন ছিল এক কোটি টন। ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫.৪ মিলিয়ন বা ৪ কোটি ৫৪ লাখ টনে। এ ৫০ বছরে খাদ্যশস্যের গড় প্রবৃদ্ধির হার হলো বছরে ৩ শতাংশ। বলাই কৃষ্ণ হাজরা বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে মন্দার কথা হচ্ছে; কিন্তু বড় কোনো জলবায়ু বিপর্যয় দেখা না দিলে বাংলাদেশে কোনো সমস্যা হবে না। নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমরা নিজেদের চাহিদা পূরণ করে প্রতিবেশী দেশগুলোকেও সহায়তা করতে পারবো।’
গত সাত চল্লিশ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে সাড়ে সাত কোটি থেকে ১৭ কোটিতে। আর প্রবৃদ্ধির হার হলো বার্ষিক ১.৯ শতাংশ। অর্থাৎ জনসংখ্যার চেয়ে খাদ্যশস্যের প্রবৃদ্ধির হার বেশি। যা ‘খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ’ বলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের দাবিরই সত্যতা প্রমাণ করে।
বলাই কৃষ্ণ হাজরা বলেন, ‘ধানের বীজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ছয় লাখ বিঘাতে এবার বোরো ধানের প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। এবার আউশ-আমন-বোরো মিলে চার কোটি মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হবে। আমাদের মোট তিন কোটি ৯৮ লাখ মেট্রিক টন ধান দরকার। কিন্তু আমার ধারণা, চার কোটি মেট্রিক টন ধান এবার উৎপাদিত হবে। আগের বছরে যা ছিল তিন কোটি ৮৩ মেট্রিক টন।’
যুদ্ধ-মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে দাবি করে তিনি বলেন, ‘সংকট সামাল দেয়ার জন্য আমরা পরিপূর্ণ প্রস্তুত। কৃষকরা এখন তিন ব্যাচে বীজ মজুত রাখেন, যাতে একটি মার খেলে আরেকটি দিয়ে তা পূরণ করা সম্ভব হয়। কৃষকরা বলছেন, আমাদের বীজ সহায়তা দরকার নেই।’
এর মধ্যদিয়ে কৃষকদের সক্ষমতারই প্রমাণ মেলে দাবি করেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে দুর্ভিক্ষের কোনো শঙ্কা নেই। যদিও গম উৎপাদন একটু কম; কিন্তু এটি আমাদের দেশের ফসল না।’
করোনায়ও সচল কৃষির চাকা
করোনা সংক্রমণের কারণে দেশের সবকিছু যখন স্থবির, তখনও সচল ছিল কৃষির চাকা। এরই মধ্যে চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ দুঃসময়ে কৃষিই সম্ভাবনার পথ দেখাচ্ছে। শুধু করোনা সংকটে নয়; গত এক দশকে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সামলে কৃষি বার বার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ধান, গম, ভুট্টা, আলু, সবজি ও মাছ উৎপাদনে শীর্ষ কাতারে উঠে এসেছে বাংলাদেশ।
বলাই কৃষ্ণ হাজরা আরও বলেন, ‘বাজারে দামের বিচারে পিঁয়াজ সবসময় আলোচনায় থাকে। আমাদের একটি গ্রীষ্মকালীন পিঁয়াজের জাত বারি-৫ আমাদের কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট আবিষ্কার করেছে। এছাড়াও ভারত থেকে এম-১৫ জাতের গ্রীষ্মকালীন পিঁয়াজের বীজ এনে চাষ করা হয়েছে। একটি পত্রিকায় খবরও হয়েছে, আঠারো কোটি টাকার বীজে ৩০৮ কোটি টাকার পিঁয়াজ হয়েছে। এখন পিঁয়াজের দাম বাড়ার কোনো শঙ্কা দেখা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আমরা একটি ভালো সাফল্য দেখিয়েছি।’
তলাবিহীন ঝুড়ি এখন উন্নয়নের মহাসড়কে
সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে তাচ্ছিল্য করা হয়েছিল। সেই বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতি ছিল এক সময় এ অঞ্চল। কিন্তু কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসে শিল্প ও সেবাখাতমুখী হয়েছে অর্থনীতি। সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেছে অর্থনৈতিক কাঠামোও। বিশাল জনসংখ্যার দেশে কৃষিজমি কমলেও কৃষি এখনও অর্থনীতির প্রাণ।
প্রযুক্তির ছোঁয়া পেয়েছে কৃষি। বদলে যাওয়া এ সময়ে কৃষিতে যুক্ত হচ্ছেন শিক্ষিত তরুণরাও। ফলে খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে অনন্য উদাহরণ। যেমনটি বলেন কৃষিবিদ ড. হুমায়ুন কবীর। সংবাদমাধ্যমকে তিনি জানান, স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের অগ্রগতিতে প্রধান ভূমিকা কৃষক, কৃষিবিজ্ঞানী ও উদ্যোক্তাদের। তাদের সাফল্যের কারণে খাদ্যঘাটতি থেকে আজ খাদ্যে অনেকটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ।
কৃষি বিজ্ঞানীদের খাদ্যশস্যের নতুন নতুন জাতের উদ্ভাবন, ভর্তুকি দিয়ে সার ও সেচের পানিপ্রাপ্তি সহজ করা, বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগসহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবন, ১ কোটি ৮০ লাখেরও বেশি কৃষকের মধ্যে কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড বিতরণ, ১০ টাকার বিনিময়ে কৃষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলাসহ নানা রকম পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে গেলো ১৪ বছরে। যে কারণে বাংলাদেশ কৃষিতে পেয়েছে অভাবনীয় সফলতা।
জমি কমলেও উৎপাদন বেড়েছে
বলাই কৃষ্ণ জানান, প্রতিবছরই বাংলাদেশে আবাদি জমি কমছে। শহরায়ণ ও নগরায়ণসহ বিভিন্ন উন্নয়ন তৎপরতার কারণে বছরে দশমিক শূন্য সাত শতাংশ জমি কমছে। কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এ জমি কমলেও আমাদের গবেষকরা এমন সব ধান, গম ও শস্যের জাত আবিষ্কার করছেন, যার ফলে এ স্বল্প জমিতেও আমরা সাফল্য ধরে রাখতে পেরেছি।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ১৯৭১-’৭২ সালে মাথাপিছু জমির পরিমাণ ছিল ২৮ শতাংশ; এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১০ শতাংশ। প্রতিবছর দেশে মানুষ বাড়ছে ২০ লাখেরও বেশি। কৃষিজমি কমছে ৮ লাখ হেক্টর। তারপরও জনপ্রতি সরবরাহ কমছে না কৃষিপণ্যের; বরং তা দিন দিন বাড়ছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি এখনো কৃষি। বিশ্বে বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে তৃতীয় স্থানে থাকলেও বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নে বাংলাদেশের স্থান হলো সবার ওপরে।
২০১৯-’২০ অর্থবছরে দেশে রেকর্ড ৩ কোটি ৮৯ লাখ টন চাল উৎপাদন করে ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে দেয় বাংলাদেশ। আর চাল উৎপাদনকারী শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে দেশটি। এছাড়া ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম, পাট উৎপাদনে বাংলাদেশ দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, মৎস্য উৎপাদনে তৃতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম এবং আলু উৎপাদনে সপ্তম স্থানে রয়েছে। এছাড়া কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বের দ্বিতীয় এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে বাংলাদেশ।
অন্যদিকে কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, বছরে ১০ শতাংশ হারে ফল চাষের জমি বাড়ছে। এক দশকে দেশে আম উৎপাদন দ্বিগুণ, পেয়ারা দ্বিগুণের বেশি, পেঁপে আড়াই গুণ এবং লিচু উৎপাদন ৫০ শতাংশ হারে বেড়েছে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চার গুণ, গম দুই গুণ, ভুট্টা ১০ গুণ ও সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ। খাদ্যশস্য ছাড়াও মাছ উৎপাদনেও বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলে মাছ রফতানিও বাড়ছে। আলু উৎপাদনে উদ্বৃত্ত। তাই দুর্ভিক্ষ, মঙ্গা আর ক্ষুধার দেশে এখন ঈর্ষণীয় উন্নতি হয়েছে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহে।
খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক সম্প্রতি সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা এবার বেশি পিঁয়াজ আমদানি করিনি। এপ্রিল মাসে যে পিঁয়াজটা তোলা হয়, এটি গত বছর ভালো হয়েছে। আমাদের সমস্যা হলো, পিঁয়াজ মজুত রাখা। এটা না হলে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। একটি পত্রিকায় খবর এসেছে, এক বিঘা জমিতে প্রায় বিশ থেকে পঁচিশ হাজার টাকা খরচ করে, এক লাখ টাকার পিঁয়াজ বিক্রি করতে পেরেছে কৃষক।’
কৃষিতে নতুন জাত
গবেষণা করে বিভিন্ন ফসলের ৯৭২টি জাত ও ১৩৯২টি উন্নত কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতে এটি বড় ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে মুখ্য ভূমিকা রেখে চলেছে এ প্রযুক্তি।
বিশেষ করে বিনা ১৬, বিনা ১৭ ধান ব্যাপক ভালো হচ্ছে; কৃষকরাও সুফল পাচ্ছেন। বিনা ধান-১৭ খরা সহিষ্ণু স্বল্পমেয়াদি। সার কম লাগে উন্নত গুণাগুণ সম্পন্ন আমন ধানের এ জাতটিতে।
লবণাক্ত এলাকা ছাড়া দেশের সব রোপা আমন অঞ্চল বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে জাতটির অধিক ফলন পাওয়া যায়। বিনা ধান-১১ বন্যা সহিষ্ণু ও অধিক ফলনশীল আমন ধানের জাত। এ জাতটি ২৫ দিন পর্যন্ত পানিতে সম্পূর্ণ ডুবে থাকলেও মারা যাবে না।
বিনা উদ্ভাবিত জাতের মধ্যে ধানের ২৪টি, তেল ফসল ৩০টি, ডাল ফসল ৩৩টি, গম ১টি, পাট ২টি, সবজি ১৪টি, মসলা জাতীয় ৬টি এবং লেবু জাতীয় ২টি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এর ফলে দেশের কৃষি গবেষণা, কৃষি সম্প্রসারণ ও কৃষি শিক্ষায় এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের অনেক খাতেই গর্ব করার মতো সাফল্য রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কৃষিখাত। এ অর্জনের পেছনে সবার আগে অবদান রয়েছে দেশের কৃষি বিজ্ঞানীদের। বর্তমান সরকারের সহায়তা ও সুযোগ-সুবিধার কারণ তারা গবেষণায় মন দিতে পেরেছে। এতে ধানসহ বিভিন্ন ফসলের নতুন নতুন জাতের উদ্ভাবন ঘটিয়েছেন, যাতে অল্প জমিতে বেশি ফসল ফলানো যায়।
সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, একদিকে কৃষিজমি কমেছে, অন্যদিকে জনসংখ্যা প্রায় তিনগুণ বেড়েছে; কিন্তু দেশে খাদ্যের উৎপাদনও তিনগুণ বাড়ানোর মূল কারিগর এ বিজ্ঞানীরা। তাছাড়া কৃষির আধুনিকায়ন, সার ও সেচের পানি সহজ করাও বড় ভূমিকা রেখেছে।
জিডিপিতে কৃষির অবদান
স্বাধীনতার পর দেশের ৮৫ শতাংশ মানুষ কৃষির ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল ছিল। বর্তমানে এ হার ৪০.৬ শতাংশ। ১৯৭৩-৭৪ সালে জিডিপিতে কৃষির অবদান ছিল ৫৮.০৪ শতাংশ, ২০১৯-২০ সালে ১৩.৩০ শতাংশ, বর্তমানে তা ২০ শতাংশের নিচে নেমে এলেও মোট অবদান বেড়েছে প্রায় ৬.০ গুণ। বাংলাদেশে কৃষি জাতীয় অর্থনীতির জীবনীশক্তি। দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪২ দশমিক ৬২ শতাংশ কৃষিক্ষেত্রে নিয়োজিত।
গত দুই বছরে করোনার প্রকোপে যখন জিডিপিতে সর্বোচ্চ অবদান রাখা সেবাখাতসহ অন্যান্য খাতে ধস নেমেছিল, তখন কৃষিখাতই দেশের অর্থনীতিকে প্রাণবন্ত রাখতে পেরেছিল।
কৃষিতে প্রযুক্তি
এক সময় লাঙল-জোয়াল আর হালের বলদই ছিল চাষাবাদের মূল উপকরণ। কিন্তু সেই জায়গা এখন দখল করেছে ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, কম্বাইন্ড হার্ভেপার, ব্রডকাস্ট সিডার পাওয়ার রিপার মেশিন।
এমনকি ফসল ফলানোর জন্য জমি চাষ, বীজ বপন, নিড়ানি, সার দেয়া, কাটা, মাড়াই, ফসল ঝাড়া ও প্যাকেটিং পর্যন্ত—সব কিছুই করা হচ্ছে প্রযুক্তি ব্যবহার করে। ফলে কৃষিতে উৎপাদন বাড়ছে, কমছে উৎপাদন ব্যয়। প্রযুক্তির ব্যবহারে ফসলের অপচয়ও কম হচ্ছে। আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকের।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশের মোট আবাদি জমির ৯০-৯২ ভাগ চাষ হচ্ছে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে। যদি চাষাবাদের সব পর্যায়ে অর্থাৎ জমি তৈরি থেকে শুরু করে চাল উৎপাদন পর্যন্ত পুরোপুরি আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়, তাহলে রীতিমতো বিপ্লব ঘটবে কৃষিতে।
কৃষিবিদ ফজলুল হক বলেন, কৃষি যন্ত্রসামগ্রী নির্মাণ দেশের অর্থনীতি এবং কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এই খাতটি এখনো ভারী শিল্প হিসেবে চিহ্নিত। কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক বা প্রস্তুত শিল্পকে কৃষিভিত্তিক শিল্পের আওতায় আনা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। গ্রামীণ শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশ এখন কৃষিকাজ করে। এ হার ২০৩০ সালে ২০ শতাংশে নামবে। আগামী দিনে দেশে হারভেস্টর, ট্রান্সপ্ল্যান্টারের মতো কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার বাড়বে।
তরুণরা আসছেন কৃষিতে
প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যমের খবরে প্রায়ই হাঁস-মুরগি পালন, গরুর খামার বা মাছের খামার করে ভাগ্য বদলে যাওয়ার গল্প শোনা যাচ্ছে। এসব বাংলাদেশে এখন আর নতুন কোনো ঘটনা নয়। কৃষিনির্ভর এই দেশের কৃষক ও খামারি পর্যায়ে চালু হয়েছে নতুন মেরূকরণে হেঁটে চলার গল্প।
একসময় গ্রামাঞ্চলে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালনই ছিল কৃষকের বাড়তি আয়ের উৎস। কিন্তু কালের পালাবদলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষিত বেকার যুবক ও নারীরা হাঁস, মুরগির বিকল্প হিসেবে বেছে নিচ্ছেন বিকল্প প্রজাতির পাখির খামার।
এদের মধ্যে টার্কি, তিতির, উটপাখির খামার উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে গরু, ছাগল পালনের পাশাপাশি বিকল্প পশুর খামারে ঝুঁকছেন শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম। বাংলাদেশের কৃষি খামারে যুক্ত হয়েছে হরিণ, কুমির, সাপ, উটের মতো বৈচিত্র্যময় পশু।
ফল ও সবজি চাষেও তরুণরা দেশের কৃষির চিত্র পাল্টে দিচ্ছেন। আম, বিদেশি ফল ও সবজি চাষে তারা সূচনা করেছেন নতুন দিগন্তের। যেমন দক্ষিণের জেলা পিরোজপুরের তরুণরা সমতল ভূমিতে মাল্টা চাষে সফল হয়েছেন। ঢাকার অদূরে সাভার ও গাজীপুরের কালিয়াকৈরে সবজি চাষে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছেন তরুণরা। রাজশাহীতে আম আর ধানচাষে তারা সূচনা করেছেন নতুন দিগন্তের। পাহাড়ি অঞ্চলে আম, কমলা, আনারস, কলা আর পেয়ারা চাষে বদলেছে ভাগ্যের চাকা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মতে, তরুণরাই এখন কৃষির প্রাণ। এখন কৃষিকাজে জড়িতদের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণ।
এখন যারা কৃষিকাজ করেন, তাদের ১৫ থেকে ২০ ভাগ শিক্ষিত বলে জানিয়েছেন কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. আসাদুজ্জামান। তার মতে, আর কৃষি বলতে ধান চাষ বা পাট চাষ বুঝায় না, এর গন্ডি অনেক বড়। শিক্ষত তরুণরা কৃষিতে আসায় এই খাতটা নতুন রূপ পাচ্ছে। কারণ, নানা সূত্র থেকে তারা কৃষি বিষয়ক তথ্য যোগাড় করতে পারে। তার কাছে মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার কৃষির খবর আছে। সে সহজেই নতুন কিছু গ্রহণ এবং প্রচলন করতে পারে।
কৃষিতে ভর্তুকি
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেটে কৃষি এবং কৃষকের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ইউরিয়াসহ সব সারের দাম বেড়েছে বহুগুণে, কিন্তু সরকার আগের দামেই সার দিচ্ছে কৃষককে। এজন্য সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি বাড়িয়ে ১৬ হাজার কোটি টাকায় নিতে হয়েছে তাকে।
এ সরকারের প্রথম বাজেটে (২০০৯-১০) কৃষি খাতে ভর্তুকির পরিমাণ বৃদ্ধি করে ৪ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। সেই ভর্তুকি বেড়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়।
কৃষি উৎপাদন বাড়াতে করোনার শুরু থেকেই সরকার নানা পদক্ষেপ নেয়। ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ধানকাটার যন্ত্রপাতি বিতরণ ও হাওর অঞ্চলসহ সারাদেশে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কৃষিশ্রমিকের যাতায়াতের ব্যবস্থা নেয়া হয়। কৃষি যান্ত্রিকীকরণে সারাদেশে ১ হাজার ৭৫২টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার, রিপারসহ কৃষিযন্ত্রপাতি ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ ভর্তুকি মূল্যে বিতরণ করা হয়েছে।
পাশাপাশি কৃষকদের জন্য ৪ শতাংশ সুদে প্রায় ১৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কৃষিঋণের ব্যবস্থা করা হয়। কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে ২৬২ কোটি টাকার চারা, বীজ ও কৃষি উপকরণ বিতরণ করা হয়।
দুই লাখ হেক্টর জমিতে উচ্চফলনশীল হাইব্রিড ধান চাষের জন্য ৭৬ কোটি টাকার হাইব্রিড বীজ বিনামূল্যে এবং বোরো ধান বীজে ২৫ শতাংশ ভর্তুকি দেয়া হয়। সেচের মূল্য ৫০ শতাংশ কমানো হয়। এছাড়া, পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনের জন্য ২৫ কোটি টাকার বেশি প্রণোদনা দেয়া হয়েছে।
এছাড়া প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ কৃষককে কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড দেয়া হয়েছে। ১ কোটি কৃষক ১০ টাকা দিয়ে ব্যাংক একাউন্ট খুলেছেন। ভর্তুকির টাকা সরাসরি ব্যাংকে জমা হয়। তারা সেচের জন্য সুলভমূল্যে বিদ্যুৎ এবং কৃষিযন্ত্র ক্রয়ে ৭০ শতাংশ ভর্তুকি পাচ্ছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১১:৫৬:৫৮ ২২২ বার পঠিত