গার্মেন্টস কর্মীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সেবায় নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক স্যাটেলাইট কর্ণার। গার্মেন্টস কর্মীদের সেবা নিশ্চিত করতে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জ সদরের বড় ১৫টি পোশাক কারখানায় এই কর্ণার স্থাপন করেছে।
এই প্রকল্প চালুর ফলে নারায়ণগঞ্জ সদরের ফতুল্লায় ফ্রিতে যৌন ও প্রজনণ স্বাস্থ্য সুরক্ষা সেবা পাওয়ায় পোশাক কারখানায় শ্রমিকদের ছুটির দাবি কমেছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৫৬ হাজার নারী শ্রমিক সেবা নিয়েছেন।
২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে দেশে প্রথম বারের মতো এসব কারখানায় নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর এ সেবা কার্যক্রম চালু করে। সপ্তাহে প্রতিটি কারখানায় দু’দিন করে স্যাটেলাইট কর্নারে ফ্রি সেবা দেয়া হয়।
গার্মেন্টস কর্মীদের সাথে কথা বললে তারা বাসস’কে জানান, আমরা শ্রমিকরা আগে স্বাস্থ্যসেবা বিশেষ করে যৌন ও প্রজনণ স্বাস্থ্য সেবা, গর্ভকালীন সেবা, প্রসবপূর্ব, প্রসব পরবর্তী সেবা থেকে বঞ্চিত ছিলাম। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের বাজারে সংসারে খরচ মেটাতে গিয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ক্রয়ের সামর্থ অনেকটাই বাইরে চলে গেছে। এ কারণে অনেক শ্রমিকদের অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণও ঘটে থাকে। কিন্তু পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক স্যাটেলাইট কর্ণারে বিনামূল্যে সেবা পাওয়ার ফলে আমরা নতুনভাবে অনেক কিছুই শিখতে পারছি এবং সেবা গ্রহণ করছি।
‘টাইম সুয়েটার্স লিমিটেড’ এর কর্মী আলেয়া বেগম সেবা গ্রহণ শেষে বাসস’কে জানান, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের এমন উদ্যেগ আমাদের জন্য বড় আর্শিবাদ। আমাদের যৌন ও প্রজনণ স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে এখন কোন চিন্তা করতে হয় না। কোন সমস্যা হলে আগে অনেক দূরে গিয়ে সেবা নিতে হত। এতে দেখা যেত আমাদের অফিস ছুটি নিয়ে যেতে হবে। ছুটি নিয়ে গেলে আবার সেইদিনের বেতান যদি কাটা হয়। এই ভেবে অনেকেই যেতে চাইতেন না। অনেক সময় ছুটি চাইলেও পাওয়া যেত না। আবার খরচের একটা বিষয় ছিল। ফলে সমস্যা গুলো দিনের পর দিন চলতে থাকায় এক সময় জটিল আকার ধারণ করতো। এখন গার্মেন্টসে স্যাটেলাইট কর্ণার স্থাপনের ফলে আমাদের সমস্যা হয় না। আমরা হাতের কাছেই সেবা পাচ্ছি।
মেট্রো নিটিং অ্যান্ড ডাইং ফ্যাক্টরির কর্মী আঁখি খাতুন বাসস’কে জানান, এসব স্যাটেলাইট কর্ণার আমাদের ভরসাস্থলে পরিণত হয়েছে। কোন ধরনের সমস্যা হলে আমরা সাথে সাথে সেবা নিতে পারছি। এমন উদ্যোগের জন্য আমি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরকে ধন্যবাদ জানাই।
জানাগেছে, পরিবার পরিকল্পনা, গর্ভবতী চেক আপ, পুষ্টি সেবা, প্রসব পরবর্তী সেবা, সাধারণ রোগের সেবা কারখানার স্যাটেলাইট কর্ণার থেকে গ্রহণ করেন কর্মীরা। বিনামূল্যে এই সেবা পাওয়ায় তাদের অর্থের সাশ্রয় হয়। এছাড়া কারখানাতেই বিনামূল্যে ডেলিভারির জন্য বিভিন্ন রেফারকৃত কেন্দ্রের তথ্য পাওয়া যায়। মাসিকের সময় স্বাস্থ্য সম্মত স্যানিটারি ন্যাপকিন দেয়া হয়। এতে শ্রমিকদের ছুটি নেয়ার প্রয়োজন হয় না। আগে এসব সমস্যার কারণে অধিকাংশ নারী শ্রমিক ছুটি কাটাতেন। বর্তমানে কেউ ছুটির জন্য আবেদন করে না।
নিট কনসার্ন লিমিটেডের এইচআর এডমিন সোহেল বাসস’কে জানান, কারখানায় সপ্তাহে দু’দিন করে স্যাটেলাইট কর্ণার বসিয়ে পরিবার পরিকল্পনা সেবা চালু করায় মালিক ও শ্রমিক উভয়ে লাভবান। সেবা পাওয়ায় শ্রমিকদের ছুটি চাইতে হচ্ছে না। এছাড়া কারখানায় পরিবার পরিকল্পনার পক্ষ থেকে সেসব ওষুধ ও সামগ্রী দিচ্ছে তার মান অনেক ভালো। কারখানার স্যাটেলাইট কর্ণারে শুধু শ্রমিকরা নয় কর্মকর্তারাও সেবা নিয়ে থাকেন। চিকিৎসা ব্যয়ের জন্য এখন শ্রমিকরা কেউ অগ্রিম বেতনও চায় না।
এ বিষয়ে নারায়নগঞ্জ জেলার দায়িত্ব প্রাপ্ত মনিটরিং কর্মকর্তা এবং পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক (সমন্নয়ক) মতিউর রহমান বাসস’কে বলেন, গার্মেন্টস কর্মীদের সেবা প্রদানের জন্য গার্মেন্টসে স্যাটেলাইট কর্ণার স্থাপন একটি সফল উদ্যোগ বলে আমি মনে করি। এই কাজটি করতে আমাদের কর্মকর্তাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। প্রথমত; গার্মেন্টস মালিকদের বুঝাতে হয়েছে, মিড লেভেল কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে হয়েছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর হতে স্যাটেলাইট ক্লিনিক সংগঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ঔষধ, এমএসআর, পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রী সরবরাহের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রজেক্টর প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কারণ, এসব সোনালী কন্যারা পরিবার পরিকল্পনা সেবার বাইরে থাকলে আমাদের টার্গেটে আমরা পৌঁছতে পারবোনা এবং এসডিজি’র লক্ষ্য মাত্রা অর্জন কঠিন হবে।
তিনি বলেন, এই সেবা কার্যক্রম গার্মেন্টসে সম্প্রসারণের ফলে এসব গার্মেন্টসে কর্মরত হাজার হাজার নারী পরিবার পরিকল্পনা, মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা, প্রজনণ স্বাস্থ্য সেবা ও পুষ্টি সেবা এবং পরামর্শ পাচ্ছে। গার্মেন্টস মালিকরা তাদের গার্মেন্টসে সরকারীভাবে স্যাটেলাইট কর্ণার স্থাপন করে এসব সোনালী কন্যাদের সেবা প্রদানে খুব খুশী। কারণ, এর ফলে তাদের কর্মীদের ঋতুকালীন সময়ে অনুপস্থিতির যে বিষয় ছিল তা কমে এসেছে এবং উৎপাদন শীলতা বেড়েছে। তাছাড়া বিদেশী ক্রেতাদেরকে তারা দেখাতে পারছেন তাদের কর্মীদের জন্য পরিবার পরিকল্পনা, মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা, প্রজনণ স্বাস্থ্য সেবা প্রদান নিশ্চিত করা হয়েছে। এর ফলে বিদেশী ক্রেতারা সন্তুষ্ট হচ্ছে। আর গার্মেন্টস কর্মীগণ তাদের হাতের নাগালে এসব সেবা পেয়ে অত্যন্ত খুশী। কারণ, সরকারী কর্মীরা যখন তাদের বাড়ীতে যেত তখন তারা কর্মক্ষেত্রে থাকায় সেবা নিতে পারতেন না। এখন আর সেই সমস্যা নেই।
সদর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা প্রদীপ চন্দ্র রায় বাসস’কে বলেন, গার্মেন্টসে কর্মরত নারী কর্মীদের মানসিক চাপ মুক্ত রাখতে নারায়ণগঞ্জ সদরের বড় ১৫টি পোশাক কারখানায় পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক স্যাটেলাইট কর্ণার স্থাপন করা হয়েছে। এসব স্যাটেলাইট কর্ণারে এ পর্যন্ত প্রায় ৫৫ হাজার ৬১৯ জন নারী শ্রমিক যৌন ও প্রজনণ স্বাস্থ্য সুরক্ষা সেবা নিয়েছে।
তিনি বলেন, শিশু মৃত্যুহার হ্রাসে সাফল্যের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমডিজি অ্যাওয়ার্ড-২০১০ অর্জন করেছেন। চেষ্টা করছি সদরে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য সবার কাছে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছানোর।
বাংলাদেশ সময়: ১৬:০২:৪৩ ১৭৫ বার পঠিত