মোস্তাফিজার রহমান রংপুর প্রতিনিধি: ছোটবেলা থেকেই শারীরিক উচ্চতা নিয়ে নানা কটু কথা শুনতে হয়েছে নীলকান্তকে। খর্বকায় হওয়ায় সবাই তাকে দেখত আলাদা চোখে। তার মনে হতো মানুষ হয়েও সে যেন আলাদা এক প্রাণী। নানা সময়ে নিজের পরিবার ও আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে সবাই তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে এসেছেন ৷
তবে মানুষের কথায় থেমে যাননি নীলকান্ত। সমবয়সীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পড়াশোনা করার চেষ্টা করেছেন। তার স্বপ্ন ছিল ভালো চাকরি করার। তবে পারিবারিক সমস্যায় এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না পারায় সেই স্বপ্ন আর আলোর মুখ দেখেনি।
পড়াশোনা আর চাকরির স্বপ্নে ব্যর্থ হলেও ভালোবাসার স্বপ্নে তিনি সফল। ভালোবাসা দিবসেও অনেকে যখন জীবনসঙ্গী, প্রেম-বিয়ে নিয়ে চিন্তিত, তখন গীতা রানির সঙ্গে ভালোবাসায় ভরা জীবন সাজিয়েছেন নীলকান্ত। সময়ে-অসময়ে পাশে থেকে একসঙ্গে তারা পার করেছেন ২৫ বছর। একই উচ্চতা আর মনের মিল হওয়ায় অভাবের মাঝেও এই দম্পতির জীবন কাটছে বেশ আনন্দে।
মঙ্গলবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) ভালোবাসা দিবসে সঙ্গে নিজেদের ভালোবাসার ও দাম্পত্য জীবনের গল্প ভাগাভাগি করেছেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার নারগুন ইউনিয়নের জোতপাড়া গ্রামের বাসিন্দা নীলকান্ত ও গীতা রানি। সাংসারিক জীবনে এক মেয়ে সন্তানের বাবা-মা তারা। কয়েক মাস একে অপরকে চেনাজানার পর ১৯৯৮ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তারা। দুজনের উচ্চতা প্রায় ৩ ফুট। খর্বকায় হওয়ায় তাদের দুজনকেই শুনতে হয়েছে সমাজের কটু কথা। কিন্তু সেসব কথাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একে অপরকে ভালোবেসে তারা একসঙ্গে পার করে দিয়েছেন দুই যুগ। এলাকায় তাদের জুটি এখন ভালোবাসার এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
জানা যায়, একসঙ্গে দীর্ঘ দুই যুগ ধরে সংসার করছেন তারা। একজন যেন আরেকজনের পরিপূরক। হাজারো অভাবে ছেড়ে যাননি একে অন্যকে। তাদের ভালোবাসার এমন দৃষ্টান্ত নজর কেড়েছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের।
স্থানীয় প্রতিবেশী স্কুলশিক্ষিকা সাবিত্রী রাণী বলেন, তারা শুধুমাত্র দেখতে খাটো। এটিই তাদের একটা অপূর্ণতা। তাদের মিল-মহব্বত অনেক বেশি। আমরা তাদের মাঝে কখনো বড় কোনো সমস্যা দেখিনি। তারা সবসময় হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করে। তাদের মতো স্বামী-স্ত্রী প্রতিটি সংসারে হওয়া উচিত।
নীলকান্ত ও গীতা দম্পতির মেয়ে লিপা বলেন, আমার বাবা-মা আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। আমাকে পড়াশোনা করিয়েছেন, বিয়ে দিয়েছেন। এখনো আমি যাতে আমার পরিবারকে নিয়ে সুখী থাকি সেজন্য পরিশ্রম করেন। অনেকেই আমার বাবা-মাকে নিয়ে কটাক্ষ করে। আমি কষ্ট পেলেও জানি আমার বাবা-মাই সেরা। আর তারা একে অপরকে খুব ভালোবাসেন।
নীলকান্তের বউ গীতা রানি বলেন, আমরা একসঙ্গে থাকতে পেরে অনেক খুশি। অভাব তো সবার সংসারেই থাকে, আমাদেরও আছে। বাইরে কাজ করলে আমাদের পারিশ্রমিক কম দেওয়া হয়। তারপরও থেমে তো আর নেই। আমরা একসঙ্গে ২৫ বছর ধরে আছি। বাকী জীবনটা একসঙ্গে থাকতে চাই।
নীলকান্ত বলেন, চার ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট আমি। হয়তো সৃষ্টিকর্তা আমাকে এভাবেই পৃথিবীতে বাঁচাতে চেয়েছেন। তিনি আমাকে ভালো রেখেছেন। মানুষের কটু কথা শুনেও আমি পড়াশোনা করতে চেয়েছি। তবে পারিবারিক সমস্যার কারণে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা হয়নি। তারপর থেকে কাজ করে সংসার চালাই। এক মেয়ে আছে আমার। তাকে পড়াশোনা করিয়ে বিয়ে দিয়েছি। বাবার দেওয়া ভিটেমাটি ছাড়া আর কিছু নেই আমাদের। শুধু যে ঘরটিতে থাকি সেটিই আমার। বাবা-মায়ের ঘরটা মায়ের নামে। কিছুদিন আগে বাবা মারা গেছেন। মা আমার নামে জমিটা দিতে চান। তবে সেটি আমার নামে করে নেওয়ার মতো টাকাও আমার নেই। কয়েক মাস আগে এক দোকানে থাকতাম। সেটা বাদ দিয়ে এখন দিনমজুরি করি। ঘরটাও আমার প্রায় ভাঙা। টাকার অভাবে সংস্কার করতে পারছি না। তারপরও আমার স্ত্রী সঙ্গ দিয়ে আসছেন। কখনো তিনি আমাকে হতাশ করেননি। সবসময় আমাকে সার্পোট দিয়ে গেছেন। এটি আমার জীবনের বড় প্রাপ্তি। আর ঘর সংস্কারের জন্য আমাকে আপনারা সহযোগিতা করতে পারেন।
নারগুন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেরেকুল ইসলাম বলেন, তারা আমার ইউনিয়নে স্বামী-স্ত্রীর একটি সেরা জুটি। যদিও তারা পারিবারিকভাবে অসচ্ছল। তবে তাদের যে সম্পর্ক এটি সব দম্পতিদের জন্য শিক্ষণীয়। তাদের প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া আমরা চেষ্টা করি তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর। তার এখন ঘর সংস্কারের প্রয়োজন। সকলে তার পাশে এগিয়ে আসা দরকার।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু তাহের শামসুজ্জামান বলেন, তাদের ভালোবাসার কথা শুনে বেশ ভালো লাগল। তাদের দেখতে অনেক সুন্দর লাগছে। উপজেলা প্রশাসন সবসময় তাদের পাশে থাকবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫:৪৪:০০ ১৭৬ বার পঠিত