ইতালীর জনপ্রিয় আন্তজৃাতিক বার্তা সংস্থা ‘দ্য প্রিসেনজা-ইন্টারন্যাশনাল প্রেস এজেন্সি’র এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের মানবিক সহায়তার নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করার চলমান প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ভূমিকম্প বিধ্বস্ত তুরস্ক ও সিরিয়ায় শুকনো খাবার, কম্বল, তাঁবু এবং ওষুধের আকারে বিপুল পরিমাণ জরুরি ত্রাণ সরবরাহ করা প্রশংসনীয়। বাংলাদেশের সময়োপযোগী মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, খাদ্য, আশ্রয় এবং সামাজিক পরিষেবাগুলো সিরিয়া ও তুরস্কের পুনর্গঠনে কার্যকরভাবে অবদান রাখতে পারবে। দেশের সংকটের সময়েও এই সাহায্য প্রদান আঞ্চলিক ভ্রাতৃত্ব, মানবিকতা, দক্ষিণ এশিয়া ও মুসলিম বিশ্বের সমন্বিত উন্নয়ন এবং কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক প্রান্তিককরণ নির্বিশেষে সকলের প্রতি সহযোগিতার নীতির প্রতি বাংলাদেশ সরকারের অঙ্গীকারের প্রমাণ।’ গত ১২ ফেব্রুয়ারি নিবন্ধটি ‘দ্য প্রিসেনজায়’ ছাপা হয়।
তুরস্কের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ৪৩ হাজার ছাড়িয়েছে। আর প্রতিবেশী সিরিয়ায় মারা গেছে সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ। এ নিয়ে গত ৬ ফেব্রুয়ারি সোমবারের ভূমিকম্পে দু’দেশের মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৮ হাজারে।
এদিকে, বাংলাদেশে নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মোস্তফা ওসমান তুরান ৯ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের কাছে সাহায্য চেয়েছেন। কারণ, দেশটি জোড়া ভূমিকম্প এবং বহু আফটারশকের চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠতে লড়াই করছে। তিনি বলেছেন, তারা নগদ সহায়তা পেতে আগ্রহী নন। তবে শীতবস্ত্র, ওষুধ ও অন্যান্য উপকরণ বাংলাদেশ থেকে পেলে তাদের উপকার হবে। দূতাবাসে এক সংবাদ সম্মেলনে রাষ্ট্রদূত ভূমিকম্পের পর তাৎক্ষণিকভাবে এগিয়ে আসার জন্য বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেছেন, ‘আরও জীবন বাঁচাতে আগামী এক বা দুইদিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে। সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস এবং অন্যান্যদের সমন্বয়ে ৪৬ জন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশির অনুসন্ধান ও উদ্ধারকারী দল যা এই মুহূর্তে বিধ্বস্ত গাজিয়ানটেপে কাজ করছেন তাদের কথা উল্লেখ করে তুর্কি কূটনীতিক বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানান। এছাড়া বৃহস্পতিবার ‘তুর্কিয়ে ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করার জন্য বাংলাদেশকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়েছেন তিনি। তুরস্ক ও সিরিয়ায় সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনায় শোক প্রকাশ করতে বৃহস্পতিবার (৯ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশে একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয়েছে। ৮ ফেব্রুয়ারি, বুধবার এ সংক্রান্ত গেজেট জারি করেছে সরকার। গেজেট অনুযায়ী, দেশের সব সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি ভবন এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে। ভূমিকম্প বিধ্বস্ত তুরস্কে উদ্ধারকাজে অংশ নিতে বাংলাদেশ থেকে একটি উদ্ধারকারী দল গেছে। এতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের পাঁচ জন করে সদস্য রয়েছে।
তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, তুরস্ক ও সিরিয়ায় এমন বিপদের দিনে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ তাদের পাশে আছে। সোমবার এক শোক বার্তায় প্রধানমন্ত্রী নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রত গভীর সমবেদনা জানান। শোক বার্তায় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন। এর আগে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদও পৃথক বাণীতে শোক প্রকাশ করেন।
জাতিসংঘের জরুরি ত্রাণ সমন্বয়কারী মার্টিন গ্রিফিথস বলেছেন, ‘দুই দেশে মোট মৃতের সংখ্যা বর্তমান সংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি হবে।’ ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত তুরস্ক ও সিরিয়ায় জরুরি ত্রাণের জন্য প্রায় ৮৯০ মিলিয়ন রুপি (৮৫ মিলিয়ন ডলার) প্রাথমিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তুরস্ক ও সিরিয়ায় দ্রুত সাহায্য পাঠিয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ, রাশিয়া, চীন, ভারত, ইউক্রেন, জার্মানি, গ্রিস, ইসরাইল, ইরান, জাপান, নরওয়ে, স্পেনের মতো দেশও সহযোগিতার প্রদিশ্রুতি দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও তুরস্কের প্রতি তাদের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কাতার তুরস্কে ১০ হাজার মোবাইল বাড়ি পাঠাচ্ছে। কাতার একটি ফিল্ড হাসপাতালের সরঞ্জাম এবং মানবিক সহায়তাও পাঠাচ্ছে।
সিরিয়ায় ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই ওষুধ, সোয়েটার, শুকনো কেক, বিস্কুট, কম্বল, তাঁবুসহ ১১ টন পণ্য পাঠিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। ত্রাণ সামগ্রীর মধ্যে রযেছে ১১১০ কেজি শুকনা কেক, ৩৪৭ প্যাকেট ডাইজেস্টিভ বিস্কুট (৫৫৬ কেজি), ২৩ প্যাকেট কম্বল (১৩৮০ কেজি), ১০২ প্যাকেট ট্যাবু (৪৪২৩ কেজি), ৪৪ প্যাকেট ওষুধ (৯৮০ কেজি) এবং ১৭০ প্যাকেট সোয়েটার (১৩০০ কেজি) আছে।
বাংলাদেশ এখন প্রবৃদ্ধির দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে প্রথম স্থানে রযেছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ পরিশোধে অক্ষম হওয়া সুদানের প্রতিও সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। আইএমএফের আহ্বানে সাড়া দিয়ে, বাংলাদেশ সুদানের পাশে দাঁড়িয়েছে। এর আগেও বাংলাদেশ আইএমএফ উদ্যোগের অংশ হিসেবে তার দারিদ্র্যের শেকল ভাঙতে আফ্রিকার দেশ সোমালিযাকে ৮২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়েছে।
বাংলাদেশের অনেকের মনে দারিদ্র্য, বঞ্চনা এবং দুর্নীতির একটি চিত্র দীর্ঘকাল ধরে রয়েছে। এই নেতিবাচক চিত্রটি ভূমিকম্প ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পাশাপাশি অনেক দেশই বাংলাদেশের মানবিক কর্মকান্ডকে উপেক্ষা করে। সম্পদশালী দেশগুলোর কথা তুলে আনে প্রায়শই। তবে সময়ের মানবিক প্রয়োজনে এখন বাংলাদেশও বিশ্ব প্রচার মাধ্যমে প্রদীপের আলোয় উঠে আসছে।
ক্রমবর্ধমান এই মানবিক কাজের উদ্দেশ্য কী? বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশ তার প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক গড়তে ও বিশ্বব্যাপী ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে কাজ করছে। দেশটির ক্রমাগত মানবিক সহায়তা কার্যক্রম, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সংকট, ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের দখলদারিত্ব এবং বিশ্বব্যাপী সংকটে জনগণকে সহায়তা করার সক্রিয় প্রচেষ্টা বাংলাদেশকে মানবিকতার প্রতীকে পরিণত করেছে। অনেক ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ চমৎকার মানবিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। নিজেকে এক দাতা দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি উন্নত করবে নিশ্চয়ই।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্ত অঞ্চলে ভূমিকম্প হয়। ভয়াবহ এই ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েই চলেছে। স্থানীয় সময় সোমবার ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার প্রথম ভূমিকম্প আঘাত হানে। এরপর সোমবার দুপুর ও বিকেলে আরও দ’ুটি শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। এদিকে, তুরস্কের দুর্যোগ ও জরুরি ব্যবস্থাপনা প্রেসিডেন্সি (এএফএডি) জানিয়েছে, তুরস্কের স্থানীয় সময় সোমবার বিকেলে ৭ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। তুরস্ক ছাড়াও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকাও ভয়াবহ ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে গেছে। হাজার হাজার ভবন ধসে পড়ে। সোমবার ভোরে যখন ভূমিকম্প হয় তখন অধিকাংশ মানুষ ঘুমিয়ে ছিলেন। মুহূর্তের মধ্যে মৃতদেহ ও আহতদের উদ্ধার করা হচ্ছে। মৃতের সংখ্যা প্রায় দুই হাজারে পৌঁছেছে। এই সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আহত হাজার হাজার মানুষ। স্বজনদের খোঁজে হাসপাতাল ও ধসে পড়া ভবনের সামনে ভিড় করছেন সাধারণ মানুষ।
তুরস্কের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা থেকে মোট ৪১ হাজার মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে। প্রায় ৮০ হাজার আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আর ভূমিকম্পের কারণে ১০ লাখের বেশি মানুষ গৃহহীন হয়ে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে বসতি স্থাপন করেছে।
তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতে বলেছেন, ‘সরকারের মূল লক্ষ্য আগামী এক বছরের মধ্যে এই গৃহহীনদের জন্য স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করা। যাতে ক্ষতিগ্রস্তরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভূমিকম্পের আঘাত ভুলে যেতে পারে।’
বাংলাদেশ সময়: ১৫:৩১:৪৮ ১৬৭ বার পঠিত