মোস্তাফিজার রহমান রংপুর প্রতিনিধি: বিভিন্ন সুপার শপে বেশি দামে বিক্রি হওয়া একটি খাদ্যপণ্যের চাষ হচ্ছে দেশের উত্তরের জনপদ গাইবান্ধায়। গোবিন্দগঞ্জসহ জেলার অন্য উপজেলার নদীবেষ্টিত চরাঞ্চলের কয়েকটি গ্রামের মাটিতে দিন দিন এ খাদ্যপণ্যের চাষ বাড়ছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন সুপার শপে প্রায় হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় থাইল্যান্ড থেকে আমদানি করা একই মানের মাত্র তিন মাসে উৎপাদিত কন্দল জাতীয় ফসলটি। বিগত দুই বছর ধরে একপ্রকার নীরবেই কৃষি বিপ্লবের জন্ম দেওয়া ফসলটি মিষ্টি আলুর বিশেষ জাত। একটি জাপানি কোম্পানির প্রত্যক্ষ সহায়তায় চাষ হওয়া মিষ্টি আলুর জাতটির নাম ‘কোকি-১৪-গো’। সাধারণভাবে অনেক সস্তা দামের ফসল মনে হলেও এটি আসলে অনেক দামি খাদ্যপণ্য।
নদীভাঙনে বিপর্যস্ত জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার বাঙালী নদীর তীরবর্তী কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দা একসময় দিন কাটাতেন খেয়ে-না খেয়ে। বিগত দুই দশক আগে সেখানকার চরের মাটিতে বন্যার পানি নামার পর তিন-চার মাসের কন্দল জাতীয় ফসল চাষ শুরু হলে বাঁচার অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায় এ মিষ্টি আলু। এরপর ধীরে ধীরে নিজ এলাকার বাইরে দেশের বিভিন্ন জেলায় বাজার তৈরি হওয়ায় বদলাতে শুরু করে এখানকার মানুষের ভাগ্য। একসময় এখানকার উৎপাদিত মিষ্টি আলু ছিল সবচেয়ে সস্তা দামের কৃষিপণ্য।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় বাজারজাত শুরু হলে কয়েক গুণ বেশি দাম পাওয়ায় স্বচ্ছলতা আসে তাদের সংসারে। তখন থেকে নদীভাঙনে সর্বস্বান্ত এক সময়ের এ ‘দুঃখের চরে’র বাসিন্দারা এলাকার নাম বদলে ডাকতে শুরু করেন ‘সুখের চর’ বলে। মিষ্টি আলু চাষের উর্বর ভূমি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় চরগুলোয় সম্প্রতি শুরু হয়েছে উন্নত জাতের ও উচ্চমূল্যের ‘কোকি-১৪-গো’ জাতের জাপানি মিষ্টি আলুর চাষ।
গত দুই মৌসুমে জাপানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি শুরু হয়েছে এখানকার মিষ্টি আলু। জাপানি একটি কোম্পানির সহায়তায় এখন এ আলুর চাষ ছড়িয়ে পড়েছে গাইবান্ধাসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায়। নীরবে ঘটে যাওয়া একটি কৃষি বিপ্লবের অংশীদার হয়ে উঠেছেন উত্তর জনপদের এ এলাকার চাষিরা।খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের নদী তীরবর্তী কিছু চরাঞ্চলে রবি মৌসুমের কন্দল ফসল হিসেবে মিষ্টি আলুর ব্যাপক ফলন হয়ে তাকে। এ মাটিতে মানসম্পন্ন জাতের জাপানি মিষ্টি আলুর চাষ সম্ভব বিবেচনা করে দুই বছর আগে চাষ শুরু করা হয় এ আলুর। জাপানের ‘মারুহিশো প্যাসিফিক গ্রুপে’র প্রতিষ্ঠান ‘নারুতো জাপান কোম্পানি লিমিটেড’ চাষিদের মাঝে চারা, সার ও কারিগরী সহায়তা দিয়ে এ মিষ্টি আলুর চাষ শুরু করে।
গাইবান্ধাসহ দেশের ৫ জেলা দিনাজপুর, বগুড়া, জামালপুর ও শেরপুরের কয়েকটি এলাকার চাষিদের সহায়তা দিয়ে তাদের উৎপাদিত আলু নির্দিষ্ট দামে সংগ্রহও শুরু করে তারা। বর্তমানে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ, সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলায় পুরোদমে শুরু হয়েছে মিষ্টি আলু রোপণের কাজ। চলতি বছর থেকে রংপুরের মিঠাপুকুর ও পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জেও প্রদর্শনী ক্ষেতের মাধ্যমে শুরু হয়েছে এ আলুর চাষ।
সরেজমিনে দেখা যায়, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার বড়দহ, পারসোনাইডাঙ্গা, চরবালুয়া, বোচাদহ ও সাঘাটা উপজেলার কচুয়া ও চন্দনপাট গ্রামে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। চাষিরা বিঘার পর বিঘা জমিতে শুরু করেছেন এ আলুর চারা রোপণের কাজ। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের দম ফেলার মতো কোনো অবকাশ নেই।
নারুতো জাপান কোম্পানি সূত্রে জানা যায়, টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে এ অঞ্চলের চাষিদের বীজতলায়ই নার্সারির মাধ্যমে চারা রোপণ করা হয়। এ সময় তাদের মূল বীজ, সারসহ প্রয়োজনীয় সব উপাদান সরবরাহ করা হয়। আবার ওই চারা দশ ইঞ্চি মাপে কেটে কেটে নেওয়া প্রতিটি খণ্ডের দাম ৩৫ পয়সা হিসেবে চাষিদের কাছ থেকে কিনে তাদেরই বিনা মূল্যে সরবরাহ করা হয়।
৫৬টি নার্সারি থেকে এ বীজ উৎপাদন করে সরবরাহ করা হচ্ছে। এ ছাড়াও আবাদ করার জন্য সারসহ সব প্রয়োজনীয় উপকরণ বিনা মূল্যে প্রদান করে উৎপাদিত আলু নির্ধারিত ১২,৯৬০ টাকা মেট্রিক টন দরে তাদের জমি থেকেই কিনে নেওয়া হয়। এরপর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে অবস্থিত আদমজী ইপিজেডে কোম্পানির কারখানায় নিয়ে প্রক্রিয়াকরণের পর জাপান, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়।গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের চরবালুয়া গ্রামের আলু চাষি খায়রুল আলম রাজা বলেন, ‘কোম্পানি সার্বিক সহযোগিতা করায় কোনো প্রকার ঋণ বা ঝামেলা ছাড়াই চাষ করতে পারছি। মৌসুম শেষে নগদ ও ন্যায্যমূল্যে ফসল বিক্রি নিয়েও কোনো চিন্তা করতে হয় না। চাষিদের জন্য এটি অনেক বড় প্রাপ্তি।’
একই গ্রামের আলম মিয়া নামের এক আলু চাষি বলেন, ‘আগে খুব কষ্টে দিন কাটতো। এখন আলু চাষ করে ভাগ্য বদলে গেছে। অন্য ফসলের তুলনায় খরচ কম, দাম বেশি হওয়ায় আমরা লাভবান হচ্ছি। এখন আমরা সুখের চরের মানুষ।
নারুতো জাপান কোম্পানির ফিল্ড মনিটরিং ইনচার্জ কাজী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘চাষিরা ‘কোকি-১৪ গো’ জাতের মিষ্টি আলু চাষে ঝুঁকে পড়ছেন। গতবছর গোবিন্দগঞ্জ এলাকা থেকে ৯০ মেট্রিক টন, সাঘাটা উপজেলা থেকে ৯৫ মেট্রিক টন ও ফুলছড়ি এলাকা থেকে ৩৪ মেট্রিক টন আলু সংগ্রহ করা হয়েছিল। চলতি বছর এখান থেকে এর দ্বিগুণ পরিমাণ আলু উৎপাদন ও সংগ্রহ করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। চলতি মৌসুমে সারাদেশে ৩০ হেক্টর জমিতে এ আলুর চাষ করা হচ্ছে।’
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সৈয়দ রেজা-ই-মাহমুদ বলেন, ‘কন্দল জাতীয় ফসল মিষ্টি আলুর সুদিন ফিরে এসেছে। এখানকার চাষিদের বিভিন্নমুখী সহায়তা দেওয়ায় মিষ্টি আলু চাষে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। দেশি বিভিন্ন জাতের পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানির জন্য ‘কোকি-১৪ গো’ জাতের আলু চাষেও কৃষি বিভাগ থেকে সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে।’
বাংলাদেশ সময়: ১৭:২৮:১৪ ১৪৮ বার পঠিত