প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যৌথ ব্যবসায়িক ফোরাম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দুই দেশের বেসরকারি খাতগুলোকে পারস্পরিক লাভজনক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের জন্য একক প্ল্যাটফর্মে আনতে হবে। পারস্পরিক লাভজনক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে আমাদের সম্পর্ককে পুনঃস্থাপন করতে হবে।
সোমবার (৬ মার্চ) কাতারের রাজধানীতে অনুষ্ঠিত দোহা ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২৩ ‘দ্য রাইজ অব বেঙ্গল টাইগার: পটেনশিয়ালস অব ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ এ ভাষণ দেওয়ার সময় এ কথা বলেন। তিনি কাতারের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশের কিছু থ্রাস্ট সেক্টরের দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দেন। সরকার অবকাঠামো ও লজিস্টিক খাত বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত রেখেছে বলেও তিনি জানান।
শেখ হাসিনা নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ জ্বালানি খাতে কাতারের বিনিয়োগের সুযোগের কথা উল্লেখ করে বলেন, অফশোর গ্যাস অনুসন্ধান ও জ্বালানি বিতরণ ব্যবস্থায় কাতারের দক্ষতা থেকে বাংলাদেশ উপকৃত হতে পারে।
বাংলাদেশের কৃষি প্রবৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটিও কাতারের সঙ্গে বাই-ব্যাক ব্যবস্থায় কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে সহযোগিতার সুযোগ সৃষ্টি করে। এই প্রসঙ্গে তিনি সরকারের তিনটি বিশেষ পর্যটন অঞ্চল স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে উল্লেখ করে বলেন, সেখানে কাতার রিয়েল এস্টেট এবং হসপিটালিটি উভয় ক্ষেত্রেই জড়িত হতে পারে।
এ ছাড়া কাতারের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে পোর্টফোলিও বিনিয়োগ বিবেচনা করতে পারেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন পুঁজিবাজারের আরও উন্নয়নে কঠোর পরিশ্রম করছে। আমাদের বন্ড মার্কেটকে একটি দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারে ব্যাঘাত বাংলাদেশের মতো দেশকে কঠিন জায়গায় ঠেলে দিয়েছে। ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটাতে আমরা কাতার থেকে এলএনজি আমদানি বাড়াতে আগ্রহী। আমরা বাংলাদেশ থেকে আরও রপ্তানির সুযোগ অন্বেষণ করতে কাতারকে অনুরোধ করছি।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ও কাতার দৃঢ় ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ এবং এখানকার প্রবাসী বাংলাদেশি সম্প্রদায় দুই দেশের মানুষের মধ্যে একটি চমৎকার সেতুবন্ধন। আমি আজ কাতারের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে অনেক বাংলাদেশি নাগরিককে দেখে আনন্দিত।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে এই অঞ্চলের সবচেয়ে উদার বিনিয়োগ ব্যবস্থা রয়েছে এবং প্রণোদনা দিচ্ছে ট্যাক্স হলিডে, মেশিনারি আমদানিতে রেয়াতমূলক শুল্ক, রয়্যালটি রেমিট্যান্স, প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও ফি, ১০০ শতাংশ বৈদেশিক ইকুইটি অনুমোদন, অনিয়ন্ত্রিত প্রস্থান নীতি, প্রস্থানের ওপর লভ্যাংশ এবং মূলধনের সম্পূর্ণ প্রত্যাবাসন সুবিধা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা) বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এক ছাদের নিচে অনেকগুলো সেবা দিচ্ছে। তার সরকার সমন্বিত সুবিধাসহ ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করছে এবং এখন পর্যন্ত পাঁচটি দেশের নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করা হচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, সরকার একটি আঞ্চলিক সংযোগ এবং লজিস্টিক হাবের জন্য উপযোগী অবকাঠামোতে প্রচুর বিনিয়োগ করছে। এ প্রসঙ্গে তিনি পদ্মা বহুমুখী সেতু, কর্ণফুলী নদীর টানেল, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর, ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সম্প্রসারিত তৃতীয় টার্মিনাল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেট্রো-রেল ব্যবস্থার মতো বিভিন্ন মেগা-প্রকল্পের কথা উল্লেখ করেন। এর সবই এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের দৃঢ় প্রত্যয়ের সাক্ষ্য দেয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার ইতোমধ্যে সমগ্র জাতিকে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট কাভারেজের আওতায় এনেছে। বাংলাদেশের প্রথম যোগাযোগ স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রতিযোগিতামূলক মজুরিতে সহজে প্রশিক্ষণযোগ্য কর্মীবাহিনীর একটি বড় খাত রয়েছে, যেখানে এটি নিবন্ধিত আইটি ফ্রিল্যান্সারদের বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সম্প্রদায় পেয়েছে। দেশের ছেলে-মেয়েরা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে যোগদানের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করছে। আমরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডিজিটাল ব্যাকবোনের বিকাশে বড় লাফ দিয়েছি। আমরা ধীরে ধীরে ৩৮টি হাই-টেক পার্ক তৈরি করছি। সেখানে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করা হচ্ছে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এখন জ্ঞানভিত্তিক সমাজ থেকে শক্তি নিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তোলা।
শেখ হাসিনা বলেন, কাতার ন্যাশনাল ভিশন ২০৩০ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ অংশীদার হওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে। আমরা কাতারে উন্নত কর্মসংস্থানের বাজার পূরণে আমাদের কর্মীবাহিনীকে জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে সজ্জিত করতে পারি। আমাদের জনগণের ভালো যত্ন নেওয়ার জন্য আমরা কাতার সরকার ও জনগণের কাছে কৃতজ্ঞ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন ২০২৬ সালে জাতিসংঘের এলডিসি গ্রুপ থেকে স্নাতক হওয়ার পথে রয়েছে, কারণ এর ১৬৮ মিলিয়ন মানুষ তাদের কঠোর পরিশ্রম এবং প্রতিশ্রুতি দিয়ে এটি অর্জন করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি প্রমাণ করেছে যে তার দেশ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়তে তাদের ভিশন বাস্তবায়ন করতে পারে। মহামারির ঠিক আগে বাংলাদেশের অর্থনীতি ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হারে পৌঁছেছিল।
এমনকি মহামারি চলাকালীনও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ, যখন এর মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, এক দশকে তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে এবং ২০২২ সালে ২ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এফডিআই পেয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দশটি রেমিট্যান্স উপার্জনকারী দেশের মধ্যে রয়েছে এবং এটি এখন ৪৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের জিডিপিসহ বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতি। আমরা ২০৩০ এর প্রথমার্ধের মধ্যে ২৪তম বৃহত্তম হয়ে উঠব বলে অনুমান করা হচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৯৬-২০০১ সালে প্রথম মেয়াদে তার সরকার বেসরকারি খাতের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের দ্বার পুরোপুরি খুলে দিয়েছিল। এখন বেসরকারি খাত বিকাশ লাভ করছে এবং আমাদের সরকার একটি সুবিধাদাতা হিসেবে কাজ করছে। আমরা আশা করি বাংলাদেশকে উন্নয়নের পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারব।
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্ন পূরণে তার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন এবং কাতারের নেতৃত্ব ও জনগণ এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাশে থাকবে বলে আস্থা প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৭:০২:৩১ ১৪৪ বার পঠিত