একবার রেকর্ড ভঙ্গ, আরেকবার দুশ্চিন্তা–এভাবেই চলছে আলো-ছায়ার মাঝে বেড়ে উঠা চা শিল্প। সম্পূর্ণ প্রকৃতিনির্ভর দেশের এ শিল্প জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, পাশাপাশি শ্রমিক অসন্তোষ এবং শতাধিক বছরের প্রাচীন গাছ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। গেলো মৌসুমে চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ায় ক্ষতি হয়েছে ১২০ কোটি টাকা। এবারও অনাবৃষ্টির কবলে পড়ে খরায় পুড়ছে বাগানগুলো। এতে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা চা শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের।
চা বাগানগুলো সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, চা শিল্পের জন্য জলবায়ুর পরিবর্তন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে সময় বাগানগুলো সবুজের চাদরে ঢেকে থাকার কথা, সে সময় খরায় পুড়ছে প্রায় প্রতিটি বাগান। মার্চের প্রথম দিকে চা পাতা তোলার কথা থাকলেও এবার তা শুরু হয়নি এখনও।
গেলো মৌসুমে মজুরির দাবিতে ২০ দিন চা শ্রমিকদের ধর্মঘটের পাশাপাশি আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় ১০ কোটি কেজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব হয়নি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬২ লাখ কেজি চা কম উৎপাদন হওয়ায় অন্তত ১২০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে বাগান মালিকদের। চলতি মৌসুমের শুরুতে অনাবৃষ্টি শিল্পের জন্য কোনো সুখকর সংবাদ বয়ে আনছে না।
চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা
চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ১০ কোটি কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও বৈরী আবহাওয়া ও শ্রমিক ধর্মঘটসহ নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে চা বাগানগুলো। দেশের ১৬৭টি বাগানে চা উৎপাদন হয়েছে ৯ কোটি ৩৮ লাখ কেজি। ফলে বছর শেষে ৬২ লাখ কেজি চা কম উৎপাদন হয়েছে।
২০২১ সালে ৭ কোটি ৭৭ লাখ ৮০ হাজার কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্য ছিল। তবে লক্ষ্যের চেয়েও এক কোটি ৮৭ লাখ ২৬ হাজার কেজি বেশি উৎপাদন হয়েছিল। ২০২০ সালেও দেশে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ কোটি ৪ লাখ ৫৪ হাজার কেজি বেশি উৎপাদন হয়। উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৮ কোটি ৬৩ লাখ ৯৪ হাজার কেজি চা। ২০২৩ সালে দেশের ১৬৭টি বাগানে চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে ১০ কোটি ২০ লাখ কেজি।
চা উৎপাদনে ধসের কারণ
দেশের একর প্রতি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় এক হাজার ৬শ কেজি। গেলো বছর দেশের অর্ধেক বাগান এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। গত মৌসুমে চা উৎপাদনে ধস নামার প্রধান কারণ ছিল চা শ্রমিকদের মজুরি ইস্যুতে ধর্মঘট। বছরের মাঝামাঝিতে টানা ২০ দিনের ধর্মঘটের কারণে দেশের চা উৎপাদন কমে যায়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় জুলাই ও আগস্টের উৎপাদন। জুলাইয়ে এক কোটি ১২ লাখ ৬৭ হাজার কেজি এবং আগস্টে এক কোটি সাত লাখ ৬২ হাজার কেজিতে নেমে যায় উৎপাদন, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় অনেক কম। এছাড়া অনাবৃষ্টির কারণেও চা উৎপাদন কম হয়েছে। গতবছরের তুলনায় এবার বৃষ্টির দেখা নেই বললেই চলে। পাশাপাশি ব্রিটিশ আমলের প্রথাও চা উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কারণ।
শঙ্কিত চা বাগান মালিকরা
উৎপাদনে বারবার পিছিয়ে পড়ায় এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা শঙ্কিত। সিলেটের চা ব্যবসায়ী ও পাহাড়ি টি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম এন ইসলাম মনির জানান, ক্ষতিগ্রস্ত চা বাগানের মালিকরা এরই মধ্যে তাদের চা বাগান বিক্রি করার চিন্তা করছে।
গবেষণা ও সেচ ব্যবস্থার তাগিদ
জলবায়ু পরিবর্তনের এ সময়ে টেকসই চা গাছ উদ্ভাবনে গবেষণায় মনোনিবেশ করতে হবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। এছাড়া সেচের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথাও বলছেন কেউ কেউ। আর চা শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নতুন নতুন বাগান সৃষ্টিতে দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে।
শ্রীমঙ্গল চা নিলাম কেন্দ্রের পরিচালক এস এম এন ইসলাম মনির বলেন, ‘আমরা যদি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে চাই, তাহলে আমাদের নতুন চারাগাছ লাগাতে হবে, পুরোনো গাছ উপড়ে ফেলতে হবে এবং অব্যবহৃত জমিতে আরও চা গাছ লাগাতে হবে। তাহলেই আমরা লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারব।’
শাবিপ্রবির ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টি টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ‘বিশ্বের অনেক দেশ তাদের আবহাওয়া উপযোগী চায়ের ধরন উদ্ভাবন করেছে। কিন্তু আমাদের দেশে তা হয়ে উ ঠেনি। এর জন্য আমাদের আরও গবেষণা করতে হবে।’
চা বাগানগুলোতে সেচের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পুরোনো গাছ ফেলে নতুন জাতের চা গাছ উদ্ভাবনের তাগিদ দিয়েছেন বিভাগের আরেক অধ্যাপক ড. ইফতেখার আহমদ।
আবহাওয়া অফিসের বক্তব্য
সিলেট আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজিব হোসাইন জানান, গত বছরের তুলনায় এবার বৃষ্টির দেখাই নেই। গত বছর এ সময়ে ৪১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। আর চলতি বছর একই সময়ে মাত্র ৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১২:৩৮:০৩ ২০১ বার পঠিত #চা #পুড়ছে #বাগান