মোস্তাফিজার রহমান রংপুর প্রতিনিধি: বছরের পর বছর ধরে বিল পরিশোধ না করায় রংপুর সিটি করপোরেশন (রসিক) ও বিভাগের আট জেলার ১৫টি পৌরসভার বকেয়া বিদ্যুৎ বিল দাঁড়িয়েছে ৮২ কোটি ১৮ লাখ টাকা। সেবামূলক এসব প্রতিষ্ঠানকে বকেয়া বিদ্যুৎ বিল পরিশোধে একাধিকবার চিঠি দেওয়ার পাশাপাশি মৌখিকভাবে অনুরোধ করেও পাওনা বিল আদায়ে ব্যর্থ হচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
নর্দার্ন ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) রংপুর বিতরণ অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সেবামূলক ১৬টি প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়া বিদ্যুৎ বিল বাবদ ৮২ কোটি ১৮ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা পাওনা আছে রংপুর সিটি করপোরেশনের কাছে এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বকেয়া পাওনা দিনাজপুর পৌরসভার কাছে ২১ কোটি ৮ লাখ টাকা। যার সিংহভাগ অনাদায়ী রয়েছে বছরের পর বছর।
নেসকো সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভাগুলোর অধিকাংশ সড়ক বাতিসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার বিদ্যুৎ বিল বকেয়া আছে। জনগণের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে সংযোগ সহজে বিচ্ছিন্ন করাসহ কঠোর অবস্থানে যেতে পারছেন না তারা। এ সুযোগ নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। আর এতে করে বছরের পর বছর বকেয়া বিলের অংক বেড়েই চলছে।
জানা গেছে, ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত রংপুর সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ বকেয়ার ১ কোটি ৩৩ লাখ এবং ১৫টি পৌরসভার পক্ষ থেকে ৬৮ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়। এরপরও রংপুর সিটি ১৩০টি এবং পৌরসভাগুলোর মোট ৩৩০টি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের (মিটার) বিপরীতে ডিসেম্বর পর্যন্ত বকেয়া দাঁড়িয়েছে ৮২ কোটি ১৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে রংপুর সিটি করপোরেশনের কাছে বকেয়া ২৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। দিনাজপুর পৌরসভার কাছে বকেয়া ২১ কোটি ৮ লাখ টাকা। গাইবান্ধা, পলাশবাড়ী ও গোবিন্দগঞ্জ এবং কুড়িগ্রাম পৌরসভার কাছে মোট বকেয়ার পরিমাণ ১৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা।
এছাড়াও উল্লেখযোগ্য বকেয়া পার্বতীপুর পৌরসভার কাছে ৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা, পঞ্চগড় পৌরসভার ৩ কোটি ৬৪ লাখ, ঠাকুরগাঁও পৌরসভার ৩ কোটি ৬ লাখ ও সৈয়দপুর পৌরসভার ২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।
এতো টাকা বকেয়া রাখা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রংপুর সিটি করপোরেশনের সচিব উম্মে ফাতিমা বলেন, বর্তমান সিটি মেয়রের মেয়াদের কোনো বিদ্যুৎ বিল বাকি নেই। সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ার আগে পৌরসভা থাকাকালীন বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রয়েছে। বর্তমান মেয়র এ ব্যাপারে বেশ আন্তরিক। তাই বকেয়া বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের চেষ্টা করা হচ্ছে।
এদিকে দিনাজপুর পৌরসভার মেয়র সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ২০১১ সালে বকেয়া বিদ্যুৎ বিল বাবদ পৌনে ৫ কোটি টাকার দায় নিয়ে তিনি পৌরসভার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তার পৌরসভার মূল আয় নাগরিকের ট্যাক্সের টাকা। এ টাকা থেকে বকেয়া বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করলে পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেওয়া সম্ভব হয় না। তারপরও প্রকল্প নেই বললেই চলে।
তিনবারের নির্বাচিত এই মেয়র বলেন, ভবন বাবদ ২০১২ সালের প্রথম দিকে বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে আমাদের পৌরসভার প্রায় ৩৬ কোটি টাকা পাওনা হয়েছিল। এ বিষয়ে গঠিত কমিটি সত্যতাও পেয়েছে এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চিঠি চালাচালিও হয়েছে, কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি। এখন আমাদের পাওনা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারপরও আমরা সাধ্যমতো বকেয়া বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করছি। তবে এসব বকেয়া বিলের মধ্যে ভুতুড়ে বিলও আছে।
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভাগুলো সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় দীর্ঘদিন বকেয়া বিদ্যুৎ বিল আদায় না হলেও কঠোর পদক্ষেপে যাওয়া সম্ভব হয় না। কারণ অধিকাংশ বিদ্যুৎ বিল বকেয়া আছে সড়ক বাতিসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার। তাই জনগণের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে সংযোগ সহজে বিচ্ছিন্ন করা হয় না। এ সুযোগ নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
নেসকোর রংপুর বিতরণ অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী জাকির হোসেন বলেন, বকেয়া বিদ্যুৎ বিল আদায়ে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে নিয়মিত চিঠি দেওয়া হয়। এছাড়া মৌখিকভাবেও অনুরোধ করা হয়। কেউ কেউ সাড়া দিয়ে বকেয়া বিল দিচ্ছে তবে চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। বেশিরভাগ নিয়মিত বিল দেয় না। অথচ বিদ্যুৎ অফিস থেকে প্রতি মাসে বিলের কাগজ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে দেওয়া হয়। এসব প্রতিষ্ঠান প্রতি মাসে বিল পরিশোধ না করায় পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে।
এদিকে গত ডিসেম্বর থেকে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় তিস্তার চরে স্থাপিত বেক্সিমকো গ্রুপের ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সোলার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদিত ১৩০-১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রতিদিন গ্রিডে যোগ হওয়ায় সরবরাহ ব্যবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছে। তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বিদ্যুৎ বিভ্রাট নেই বলে জানিয়েছেন প্রকৌশলী জাকির হোসেন।
২০১৬ সালের ১ অক্টোবর নেসকো রংপুর বিদ্যুৎ বিভাগের দায়িত্ব নেয়। রংপুর বিভাগের আট জেলায় বিদ্যুতের গড় চাহিদা প্রায় ৭০০ মেগাওয়াট। শীতে এ চাহিদা থাকে প্রায় সাড়ে ৫০০ মেগাওয়াট। তবে গ্রীষ্মকালে জমিতে সেচ এবং বিভিন্ন কারণে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। গত ৪ মার্চ বিদ্যুতের চাহিদা হয়েছিল ৮১২ মেগাওয়াট। গত বছর জুলাই মাসে সর্বোচ্চ চাহিদা রেকর্ড করা হয়েছিল ৯৫০ মেগাওয়াট।
বাংলাদেশ সময়: ২২:২৪:৫৫ ১৫৮ বার পঠিত