যে ব্যক্তি রমজান মাস পেল এবং তার হদ (আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত দণ্ডবিধি)সমূহ সঠিকভাবে পালন করল, সে এমনভাবে পাপমুক্ত হলো যেন সে সদ্য মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হলো। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিখ্যাত এ হাদিসটিতে রোজার আবশ্যক কর্তব্য সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। যেখানে তিনি রমজানের হক আদায় না করলে কী পরিণতি হবে তা বর্ণনা করেছেন। হাদিসের দীর্ঘ বর্ণনায় এসেছে–
হজরত কাব ইবনে উজরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, একদিন রাসুলুল্লাাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (মসজিদে নববির) মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে পা রাখলেন, তখন বললেন, ‘আমিন’। যখন দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখলেন, তখন বললেন, ‘আমিন’। যখন তিনি তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখলেন তখনও বললেন, ‘আমিন’।
হজরত কাব ইবনে উজরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, যখন তিনি (মিম্বর থেকে) নামলেন, আমরা তাঁর কাছে আমিন বলার কারণ জানতে চাইলাম। বললাম এর আগে আপনাকে কখনো এভাবে আমিন বলতে শুনিনি।
উত্তরে তিনি বললেন, প্রথম সিঁড়িতে পা রাখার সময় জিবরিল আলাইহিস সালাম আমার কাছে এসে বললেন, ‘ধ্বংস হোক সে ব্যক্তি যে রমজান মাস পেল, তবুও তার গোনাহ মাফ করাতে পারল না। আমি বললাম, ‘আমিন’।
যখন দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখলাম তখন বললেন, ধ্বংস হোক সে ব্যক্তি যার কাছে আপনার নাম উচ্চারিত হলো অথচ সে আপনার প্রতি দরুদ পাঠ করল না। আমি বললাম, ‘আমিন’।
যখন তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখলাম, তখন বললেন, ধ্বংস হোক সে ব্যক্তি যে বৃদ্ধ পিতা-মাতা উভয়কে অথবা একজনকে পেল অথচ তারা উভয় তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারল না। অর্থাৎ তাদের খেদমতের মাধ্যমে নিজেকে জান্নাতবাসী করতে পারল না। আমি বললাম, আমিন।’
(মুসলিম, তিরজিমি)
মুসলিম উম্মাহর জন্য রমজানের রোজার গুরুত্ব কতবেশি তা সহজেই বোধগম্য। রমজানের রহমত বরকত মাগফেরাত ও নাজাত পেতে মুমিন মুসলমানকে যে নমুনায় রোজা পালন করবে, যে বিষয়গুলো প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখার পাশাপাশি এ আমলগুলো করা–
১. রমজানের শুরু থেকে রাতের নামাজ তারাবিহ যথাযথ ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে আদায় করা।
২. শেষ রাতে তাহাজ্জুদ ও ক্ষমা প্রার্থনার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া।
৩. রাতের শেষ সময়ে সেহরি খাওয়া। ওয়াক্ত শেষ হওয়ার আগমুহূর্তে সেহরি খাওয়া শেষ করা। সেহরিতে পেট ভরে না খাওয়া বরং কিছু কম খাওয়ার চেষ্টা করা।
৪. সেহরির পর দেরি না করে মসজিদে চলে যাওয়া। মনোযোগের সঙ্গে ফজরের আজান শোনা এবং উত্তর দেয়া। আজানের পর দরুদ পড়ে দোয়া করা।
৫. আজানের পর সুন্নত পড়ে জামাতের জন্য অপেক্ষা করা। যতটুকু সম্ভব এ সময় মাসনুন দোয়া, জিকির এবং তওবা-ইসতেগফারে মশগুল থাকা।
৬. ফজরের নামাজের জামাতের জন্য ইকামাত শুরু হলে আজানের মতো ইকামতেরও উত্তর দেওয়া এবং আল্লাহর সামনে হাজিরা দেওয়ার মানসিকতায় এ নামাজকে জীবনের শেষ নামাজ মনে করে তা মনোযোগের সঙ্গে আদায় করা।
৭. ফজরের সালাম ফেরানোর পর নিয়মিত এ তাসবিহগুলো পড়া–
* তাকবি একবার আর ইসতেগফার তিনবার পড়া।
৮. আয়াতুল কুরসি পড়া একবার
উচ্চারণ: আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুওয়াল হাইয়্যুল ক্বাইয়্যুম। লা তাঅ খুযুহু সিনাতুঁও ওয়া লা নাওম। লাহু মা ফিস্ সামাওয়াতি ওয়া মা ফিল আরদ্বি। মাং জাল্লাজি ইয়াশফাউ ইংদাহু ইল্লা বি-ইজনিহি। ইয়ালামু মা বাইনা আইদিহিম ওয়া মা খালফাহুম, ওয়া লা ইউহিতুনা বিশাইয়্যিম্ মিন ইলমিহি ইল্লা বিমা শাআ ওয়াসিআ কুরসিইয়্যুহুস্ সামাওয়াতি ওয়াল আরদ্বি, ওয়া লা ইয়াউদুহু হিফজুহুমা ওয়া হুওয়াল ‘আলিয়্যুল আজিম।
৯. তাসবিহ ফাতেমি পড়া।
সুবহানাল্লাহ ৩৩ বার, আলহামদুলিল্লাহ ৩৩ বার, আল্লাহু আকবার ৩৩/৩৪ বার।
১০. উচ্চারণ: ‘বিসমিল্লাহিল্লাজি লা ইয়া দুর্রু মাআসমিহি শাইয়ুন ফিল আরদি ওয়া লা ফিস সামায়ি ওয়া হুয়াস সামিয়ুল আলিম’ ৩ বার পড়া।
১১. দরুদ শরিফ পড়া।
১২. তওবা ও ইসতেগফার পড়া।
১৩. সুরা হাশরের শেষ ৩ আয়াত পড়া
উচ্চারণ: ‘হুয়াল্লা হুল্লাজি লা ইলাহা ইল্লাহু। আলিমুল গাইবি ওয়াশ শাহাদাতি হুয়ার রাহমানুর রাহিম। হুয়াল্লা হুল্লাজি লা ইলাহা ইল্লাহু। আল-মালিকুল কুদ্দুসুস সালামুল মুমিনুল মুহাইমিনুল আযিযুল ঝাব্বারুল মুতাকাব্বির। সুবহানাল্লাহি আম্মা ইউশরিকুন। হুয়াল্লাহুল খালিকুল বারিয়ুল মুসাওয়্যিরু লাহুল আসমাউল হুসনা। ইউসাব্বিহু লাহু মা ফিসসামাওয়াতি ওয়াল আরদ্, ওয়াহুয়াল আযিযুল হাকিম।’
১৪. সুরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করা।
১৫. সূর্য ওঠে গেলে ৪ রাকাত ইশরাকের নামাজ আদায় করে বিশ্রামে যাওয়া।
১৬. বিশ্রামের পর (ঘুম থেকে উঠে) অফিসে, কাজে বের হওয়ার আগে ৪ রাকাত চাশতের নামাজ পড়ে নেয়া।
১৭. যাদের কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই, তাদের জন্য কোরআন তেলাওয়াত কিংবা তেলাওয়াত শোনা, কোরআন অধ্যয়ন কিংবা কোরআনের অনুবাদ বুঝে বুঝে পড়ার মাধ্যমে সময় অতিবাহিত করা।
১৮. জোহরের নামাজের আগেই ওজু ও গোসল সেরে আগে আজানের সময় কিংবা আরো আগে মসজিদে চলে যাওয়া। সুন্নাতের পর জামাআতের আগে তাসবিহ-তাহলিল, কুরআন তেলাওয়াতে মশগুল থাকা।
১৯. যারা খতম তারাবিহ আদায় করেন, প্রতিদিনের তারাবিহতে তেলাওয়াত করা কুরআনের অংশটুকু অর্থসহ পড়া। সম্ভব হলে তাফসির দেখে নেয়া। অন্তত সে অংশটুকু ভালো করে তেলাওয়াত করা।
২০. রাতের তারাবিহ সুন্দর ও প্রাণবন্ত করতে সম্ভব হলে আসরের আগে পরিমাণমত বিশ্রাম গ্রহণ করা।
২১. বিশ্রাম গ্রহণের পর আসরের নামাজের প্রস্তুতি নিয়ে মসজিদে চলে যাওয়া। সম্ভব হলে সুন্নত নামাজ পড়ে জামাতের অপেক্ষা করা এবং তাওবা-ইসতেগফার করা।
২২. আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত তেলাওয়াত, দোয়া-জিকিরে মনোনিবেশ করা।
২৩. ইফতারের আগ মুহূর্তে ইফতারি সামনে নিয়ে ইফতারের জন্য অপেক্ষা করা। আর আল্লাহর তাসবিহ ও জিকিরে মশগুল থাকা।
২৪. ইফতারের পর প্রশান্তির দোয়া পড়া- ‘জাহাবাজ্জামাউ ওয়াব তালাক্বিল উরুকু ওয়া ছাবাতাল আঝরু ইনশাআল্লাহু তাআলা।’
২৫. মাগরিবের নামাজ পড়তে মসজিদে চলে যাওয়া। ফজরের পর যে তাসবিহ ও দোয়াগুলো পড়তে বলা হয়েছে, সেগুলো পড়া। এরপর তারাবিহ নামাজের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। আর যারা কর্মব্যস্ত তারা কাজের ফাঁকে সুযোগ পেলে তাসবিহ-তাহরির, তাওবা-ইসতেগফারে নিজেকে নিয়োজিত রাখা আবশ্যক।
বাংলাদেশ সময়: ১১:৩৫:৩৭ ১৪৩ বার পঠিত