মোস্তাফিজার রহমান রংপুর প্রতিনিধি: বাংলাদেশ ক্রিকেটে লেগ স্পিনারের হাহাকার অনেক দিনের। গত কয়েক বছরে জুবায়ের লিখন, আমিনুল ইসলাম বিপ্লবদের দিয়ে চেষ্টা করা হলেও ধরা দেয়নি সাফল্য। কার্যকর লেগ স্পিনার পাওয়ার চেষ্টায় জাতীয় দলে সবশেষ সংযোজন রিশাদ হোসেন। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সর্বশেষ টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক হয়েছে এই লেগ স্পিনারের। এই সংস্করণে বাংলাদেশের ৮০তম ক্রিকেটার ২০ বছর বয়সী এই রিশাদ। নীলফামারী জেলা শহর থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে নিজপাড়া এলাকায় জন্ম তার।
বাবা আর মামার অনুপ্রেরণায় স্বপ্নপূরণে গ্রামের মাঠ থেকে বেড়ে ওঠা রিশাদ হোসেন জাতীয় দলের আশেপাশে ছিলে অনেকদিন ধরেই। ২০১৮ সালের মার্চে রিশাদ জায়গা পান বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৭ দলে। ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রায় ৫ বছরে তিন সংস্করণ মিলিয়ে সুযোগ পেয়েছেন মাত্র ২৮ ম্যাচে। চলতি ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে আবাহনীর হয়েও প্রথম তিন রাউন্ডে মাঠে নামতে পারেননি। ক্যারিয়ারের একমাত্র লিস্ট ‘এ’ ম্যাচ খেলেছেন গত বছরের প্রিমিয়ার লিগে। ১৪ টি-টোয়েন্টির সবশেষটি প্রায় দুই বছর আগে, ২০২১ সালের জুনে।
টি-টোয়েন্টি সিরিজে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে এটাই আন্তর্জাতিকে অভিষেক ম্যাচ লেগ স্পিনার রিশাদের। এদিকে অভিষেকের খবরে রিশাদের গ্রামের বাড়ি নীলফামারীতে বইছে আনন্দের বন্যা।
ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি গভীর আগ্রহ রিশাদের। নিউজিল্যান্ডের ইশ সৌধি রিশাদের আদর্শ। ক্রিকেটার হিসেবে পথ চলার শুরুটা হয় জেলা শহরের ছমিরউদ্দিন স্কুল এন্ড কলেজের অভ্যন্তরীণ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট থেকে। টানা তিন টুর্নামেন্টে সেরা খেলোয়াড় হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন রিশাদ। সেই থেকেই ক্রিকেটার হওয়ার প্রবল প্রতিজ্ঞা করে ফেলেন রিশাদ। এরপর নীলফামারীর নজরুল স্মৃতি একাডেমির হয়ে জেলার শেখ কামাল স্টেডিয়ামে অনুশীলন করতেন রিশাদ।
ছোটবেলা থেকে আমার ছেলের ক্রিকেটের প্রতি টান অনেক। শুরুতে ওর খেলার সামগ্রীর জোগান দিতে পারতাম না। আমি ওকে কাঠ দিয়ে ব্যাট বানিয়ে দিতাম। তখন ব্যাট কিনে দিতে পারতাম না, অভাব অনটনের সংসার।
২০১৭ সালে স্পিনার হান্টে যোগ দেওয়া থেকেই জীবনের বাঁক বদলের শুরু রিশাদের। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। সে বছর বিসিবির সঙ্গে মিলে দেশজুড়ে স্পিনার খোঁজার অভিযান শুরু করে মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান রবি। একাডেমির কোচদের পরামর্শে রিশাদ নাম লেখান প্রতিযোগিতায়। জেলা পর্যায়ে নির্বাচিত হয়ে বিভাগীয় পর্যায়েও জিতে রিশাদ আসেন জাতীয় পর্যায়ে। সেখানেও নজর কাড়েন বিচারকদের। শেষ পর্যন্ত স্পিনার হান্টের বিজয়ী না হলেও ছিলেন সেরা দশে। নিখুঁত নিশানা ও ধারাবাহিকতার জন্য পেয়েছিলেন সেরা ‘অ্যাকুরেসি’ স্পিনারের পুরস্কার।
স্পিনার হান্টের বিজয়ীদের নিয়ে দুটি ক্যাম্প করেছিল বিসিবি। সেখানে নিজেকে আলাদা করে তুলে ধরেন রিশাদ। ২০১৮ সালের মার্চে জায়গা পান বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৭ দলে। এর আগে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে টুকটাক বয়সভিত্তিক দলে খেললেও জাতীয় পর্যায়ে ছিল সেটিই প্রথম। ভারত সফরে খেলেন আফগানদের বিপক্ষে সিরিজে। স্পিন ক্যাম্প থেকেই নির্বাচকদের চোখ ছিল তার ওপর। স্বীকৃত ক্রিকেটে একদম আনকোরা স্পিনারকেই তারা জায়গা দেন হাই পারফরম্যান্সের স্পিন স্কোয়াডে। সেটি যদি বিস্ময়কর হয়, পরের ধাপ ছিল মহাবিস্ময়। সরাসরি ‘এ’ দল!
রিশাদের ক্রিকেট জীবনের পথচলায় ভরসার নাম বাবা নূর আলম। নিজের সর্বস্ব দিয়ে ছেলের ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন তিনি। এছাড়া মামা আসাদুজ্জামান আসাদ (সুইডেন) তার পথচলার আরেক সঙ্গী। এক জুতা পরে দুজন প্র্যাকটিস করেছেন। কখনো পরেছেন একই জার্সি-ট্রাউজার্স।
এমনও দিন গেছে যে সকালে আমি যে জুতা পরে প্র্যাকটিস করতাম, বিকেলে সে ওই জুতা পরেই প্র্যাকটিস করত। আমি মাঠে পৌঁছে দিতাম। মাঝে মাঝে একই জার্সি দুজন পালা করে পরে প্র্যাকটিস করেছি। তার অভিষেকে আমি গর্বিত, প্রত্যাশা রাখি রিশাদ যেন দেশের জন্য ভালো কিছু করতে পারে।
রিশাদের বাবা নূর আলম বলেন, ছোটবেলা থেকে আমার ছেলের ক্রিকেটের প্রতি টান অনেক। শুরুতে ওর খেলার সামগ্রীর জোগান দিতে পারতাম না। আমি ওকে কাঠ দিয়ে ব্যাট বানিয়ে দিতাম। তখন ব্যাট কিনে দিতে পারতাম না, অভাব অনটনের সংসার।
তিনি আরও বলেন, কিন্তু ওই ব্যাটে খেলা যেতো না। পরে একটা ব্যাট কিনে দেই ২০ হাজার টাকা দিয়ে। ওর মা ও আমি কখনও মানা করিনি খেলাধুলায়। আমারই আগ্রহ বেশি। রিশাদের অভিষেকের কথা শুনে গর্বে আমার বুক ভরে গেছে, এই আনন্দে আমি ঠিকঠাক কথা বলতে পারছি না। রিশাদ ভালোভাবে পারফরম্যান্স করুক। আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করি ও যেন দীর্ঘদিন খেলতে পারে।
ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি গভীর আগ্রহ রিশাদের। নিউজিল্যান্ডের ইশ সৌধি রিশাদের আদর্শ। ক্রিকেটার হিসেবে পথ চলার শুরুটা হয় জেলা শহরের ছমিরউদ্দিন স্কুল এন্ড কলেজের অভ্যন্তরীণ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট থেকে। টানা তিন টুর্নামেন্টে সেরা খেলোয়াড় হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন রিশাদ। সেই থেকেই ক্রিকেটার হওয়ার প্রবল প্রতিজ্ঞা করে ফেলেন রিশাদ।
রিশাদের মামা আসাদুজ্জামান আসাদ (সুইডেন) বলেন, রিশাদের এই জায়গায় পৌঁছানোর পেছনে রয়েছে কঠোর পরিশ্রম ও বাবা-মায়ের সমর্থন। রিশাদের পাশে থাকার কথা যদি বলেন তাহলে আমরা একসঙ্গে প্রাকটিস করতাম। এমনও দিন গেছে যে সকালে আমি যে জুতা পরে প্র্যাকটিস করতাম, বিকেলে সে ওই জুতা পরেই প্র্যাকটিস করত। আমি মাঠে পৌঁছে দিতাম। মাঝে মাঝে একই জার্সি দুজন পালা করে পরে প্র্যাকটিস করেছি। তার অভিষেকে আমি গর্বিত, প্রত্যাশা রাখি রিশাদ যেন দেশের জন্য ভালো কিছু করতে পারে।
২০০২ সালের ১৫ জুলাই জন্মগ্রহণ করা রিশাদ বর্তমানে নীলফামারী ছমির উদ্দিন স্কুল এন্ড কলেজে অধ্যয়নরত আছেন। তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ভুবন মোহন তরফদার বলেন, রিফাত আমার সরাসরি ছাত্র। আমি শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক। স্কুল থেকেই ওর ক্রিকেট যাত্রার শুরু। ও স্কুলে নিয়মিত ক্রিকেট অনুশীলনে ছিল। স্কুলের তিনটি টুর্নামেন্টে ভালো ফলাফল করে।
তিনি আরও বলেন, রিশাদের অবদানেই আমাদের স্কুল বিভাগীয় পর্যায়ে রানার্সআপ হয়েছিল। আমরা সাধারণত ওকে ভারতের স্পিনার অনিল কুম্বলের সঙ্গে তুলনা করি। রিশাদের জাতীয় দলে আজ অভিষেক হয়েছে এতে আমরা নীলফামারীবাসী গর্বিত। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড যদি ওকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে তাহলে আরও ভালো কিছু দিতে পারবে।
জেলা ক্রীড়াসংস্থার অতিরিক্ত সাধারণ সম্পাদক তরিকুল ইসলাম গোলাপ বলেন, ছোটবেলা থেকে রিশাদ অনেক চেষ্টা করেছে। তার সাফল্যে আমরা ক্রীড়াসংস্থা গর্বিত। সেই সঙ্গে পুরো জেলার মানুষ গর্বিত।
বাংলাদেশ সময়: ২৩:১১:৩৪ ১৩০ বার পঠিত