মার্চ মাসের চৈতালী ঢল আর এপ্রিল মাসের বৈশাখী ঢল। চোখের সামনে আধা পাকা ধান গাছ তলিয়ে যাওয়ার করুণ দৃশ্য হাওর এলাকার কৃষকদেরকে আর হয়ত দেখতে হবে না। এই ঢল আসার আগেই কৃষকের গোলায় উঠে যাবে বোরো ধান। এটি আর স্বপ্ন নয়। ধান বিজ্ঞানীদের ৯০ বছরের গবেষণার ধারাবাহিকতায় এটি এখন বাস্তবের পথে। চৈত্র মাসের মাঝামাঝি সময়ে কাটা যাবে এমন একটি জাতের কৌলিক সারি উদ্ভাবন করেছেন ধান বিজ্ঞানীরা।
আগামী বছরই এটি একটি নতুন জাত হিসাবে অনুমোদন পেতে পারে। নতুন কৌলিক সারি হবিগঞ্জের তিনটি হাওর ছাড়াও কিশোরগঞ্জের নিকলির হাওর ও সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে পরীক্ষামূলক ফলনে ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া গেছে। কৃষি বিজ্ঞানীরা মাঠে গিয়ে দেখতে পেয়েছেন মাঠভর্তি ফসলের মাঝে একমাত্র তাদের পরীক্ষণ জমির ফসল পেকে গেছে। ধান কেটে দেখা গেছে ফলন হয়েছে বিঘা প্রতি ১৭/১৮ মন। উপস্থিত কৃষকরাও আনন্দিত আগাম এই ফসল দেখতে পেয়ে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে, আন্তর্জাতিক ধান গবেষনা ইনস্টিটিউট (ইরি) এর সহযোগিতায় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) নতুন জাত উদ্ভাবনের কাজ শুরু করে। এর পরীক্ষণ মাঠ হিসাবে ব্যবহার করা হয় কিশোরগঞ্জের নিকলীর হাওর, হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার শীবপাশা বাকাটিয়ার হাওর, বানিয়াচং উপজেলার মকার হাওর,নবীগঞ্জ উপজেলার গুঙ্গিয়াজুরী হাওর, সুনামগঞ্জের তাহিরপুর হাওর, শনির হাওর ও মাটিয়ান হাওর।
বৃহস্পতিবার হবিগঞ্জের তিনটি হাওরে নতুন উদ্ভাবিত জাতের পরীক্ষণ মাঠের ফলাফল দেখতে আসেন গবেষণার সাথে জড়িত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক ও কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস, ব্রির মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং গবেষণার মূখ্য পরীক্ষক পার্থ সারথী বিশ্বাস, ইরির বৈজ্ঞানিক ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, খাদ্য নিরাপত্তায় স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত ধান বিজ্ঞানী ড. আব্দুল মজিদ, ব্রির বিজ্ঞানী হাবিবুর রহমান।
কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন, ব্রির হবিগঞ্জ স্টেশন ১৯৩৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। আসাম অববাহিকার হাওরের জন্য উপযোগী জাত উদ্ভাবনের কাজ করে আসছে এই প্রতিষ্ঠান। বিজ্ঞানীরা আগাম বন্যা থেকে রক্ষার জন্য সর্বপ্রথম ১৯৫০ সালে এখান থেকে আবিস্কার করেন হবিগঞ্জ বোরো-৬, যাকে পশুশাইল বলে। এই ধানের মাঝে শীতসহনশীল ও খড়াসহনশীল জিন পাওয়া গেছে। এখানকার উদ্ভাবিত রাতা বোরো ও টেপি বোরোতেও শীতসহনশীলতার জিন পাওয়া গেছে। আগাম বন্যা থেকে রক্ষার জন্য নতুন এই জাত উদ্ভাবনের জন্য অন্যতম পিতৃলাইন হিসাবে নেয়া হয়েছে হবিগঞ্জের জনপ্রিয় ধান পশু শাইলের জিন।
তিনি আরও বলেন, বন্যা থেকে ফসল রক্ষার জন্য নতুন যে জাতটি উদ্ভাবনের কাজ চলছে সেটির বীজতলা করা হবে কার্তিক মাসের ১০ তারিখের মাঝে। ওই সময় এটিকে যাতে ঠান্ডায় ক্ষতি করতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখা হচ্ছে। আবার ধানের যখন ফুল আসে সেই সময়ও শীতের সমস্যা হতে পারে। তাই শীত টলারেন্স এর প্রতি লক্ষ্য রাখার পাশাপাশি ফলনও যাতে ভাল হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখেই এই গবেষণার কাজ চলছে। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত ফলাফলে আমরা আশাবাদী ধান বিজ্ঞানীদের ৯০ বছরের গবেষণার ফসল হবে আমাদের নতুন এই জাত। প্রাথমিকভাবে বিঘা প্রতি ফলন ১৭/১৮ মন হলেও আমরা এই ফলন আরও বাড়ানোর চেষ্টা করছি।
ব্রির মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং গবেষণার মূখ্য পরীক্ষক পার্থ সারথী বিশ্বাস বলেন, আমরা ইন্দোনেশিয়া এ ধরনের জাত পেয়ে জার্মপ্ল্জাম সংগ্রহ করেছি। পশুসাইল এর জিন, ভুটান, নেপাল,কুরিয়া ও ফিলিপাইন থেকে কিছু জাত পিতৃলাইন হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। ১০টি পরীক্ষণ মাঠে নতুন এই জাতের ফসল আমরা লক্ষ্যমাত্রা সময়ের মাঝেই কাটতে পেরেছি। আমরা দ্রুত এই জাতটি নতুন জাত হিসাবে অবমুক্ত করতে পারব বলে আশাবাদী।
তিনি আরও বলেন, আমরা যে জাতটি উদ্ভাবন করতে যাচ্ছি তার ফলন হবে হেক্টর প্রতি ৭টন। ফসল এর মেয়াদ হবে ব্রি ২৮ এর সমান ১৫০দিন। যেহেতু শীত টলারেন্স আছে তাই চাইলে অক্টোবরেই এর বীজতলা তৈরি করা যাবে। শীতে এর বীজতলার কোন ক্ষতি হবে না।
ইরির বৈজ্ঞানিক ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, ২০১৭ সালে যখন আগাম বন্যা হয় তখন দেশে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার ফসল বিনষ্ট হয়। লাখ-লখ কৃষক হয়ে পড়ে সর্বশান্ত। তখন থেকেই আমার কাজ শুরু করেছিলাম কিভাবে বন্যার হাত থেকে হাওরের ফসল রক্ষা করা যায়। বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করার পর আমার এই প্রকল্প শুরু করি। কেজিএফ অর্থায়ন করায় আমরা এই গবেষণার সফলতার শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। নতুন এই জাতটি আবিস্কার হলে জাতীয় অর্থনীতির সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা সুরক্ষিত হবে এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে।
খাদ্য নিরাপত্তায় স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত ধান বিজ্ঞানী ড. আব্দুল মজিদ বলেন, আমরা নিকলীর হাওর দেখেছি। হবিগঞ্জের হাওর দেখেছি। সুনামগঞ্জের হাওর দেখব। একন পর্যন্ত আমরা যে ফলাফল পেয়েছি তাতে আমরা আশাবাদী হাওর এলাকার দুঃখ লাগবে নতুন জাতটি উপযোগী হবে। নতুন জাতটি হবে স্বল্প মেয়াদী ও শীত সহনশীল। ফলে আগাম বন্যা আসার আগেই কৃষকের গোলায় চলে যাবে এই ধান। নতুন জাত উদ্ভাবনে হবিগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী ধান পশু সাইলকে প্যারেন্ট হিসাবে নেয়া হয়েছে। পশু সাইলই ছিল প্রথম উদ্ভাবিত বন্যামুক্ত জাত।
তিনি আরও বলেন, প্রচলিত বিভিন্ন জাত যদি কেউ আবাদ করেন তাহলে শীত রোগের কারনে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উৎপাদন হয় হেক্টর প্রতি ৪ টন। কিন্তু নতুন জাতটির উৎপাদন হবে হেক্টর প্রতি ৭টন এবং শীত রোগ কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
বাংলাদেশ সময়: ২৩:৩৬:৪৪ ১৭৫ বার পঠিত