মোস্তাফিজার রহমান রংপুর প্রতিনিধি: নুর হোসেন। গায়ে গতরে খেটে খাওয়া একজন দিনমজুর। সংসারে আপনজন বলতে স্ত্রী আর সন্তান ছাড়া তেমন কেউ নেই। সম্পদের পরিসীমাও খুব বেশি নয়। বসত-ভিটা আর এর সামনে বেড়ে ওঠা তার স্বপ্নময় বেশ কিছু ইউক্যালিপটাস গাছ। অনেক দিন ধরে চেষ্টা করেছেন জরাজীর্ণ বসত বাড়িতে নতুন ঘর তুলবেন। কিন্তু অর্থাভাবে সেই কাজ করতে পারেননি। অবশেষে কয়েক বছর আগে লাগানো ইউক্যালিপটাস গাছ বিক্রি করে এবার নতুন ঘর তুলেছেন। ইউক্যালিপটাস গাছকে ঘিরে স্বপ্নে বিভোর নুর হোসেনের পরিবার।
নতুন ঘর তৈরির কাজ করা শেষে গাছের শূন্যস্থানে আবারও লাগাবে সেই ইউক্যালিপটাস গাছই। কিন্তু নুর হোসেন নিজেও জানে না তার অজান্তে পরিবেশের কতটা ক্ষতি করে যাচ্ছে স্বপ্নময় ইউক্যালিপটাস। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, বেশির ভাগ মানুষই এই ইউক্যালিপটাসের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানেন না।
রংপুরের পীরগাছার তাম্বুলপুর ইউনিয়নের বগুড়াপাড়া গ্রামের ষাট বছর বয়সী কৃষক নুর হোসেন জানান, তার প্রতিবেশীকে তিনি জমির আইলে ৫০-৬০টি ইউক্যালিপটাস লাগিয়েছেন। সাময়িক লাভের আশায় ইউক্যালিপটাস লাগিয়ে এখন তিনি ক্ষতিগ্রস্ত। আগের মতো তার জমিতে আরও ভালো চাষাবাদ হচ্ছে না। দিন দিন পানিশূন্যতায় শুষ্ক হয়ে পড়েছে তার জমি।
নুর হোসেনের মতো অগণিত মানুষ ইউক্যালিপটাস গাছকে ঘিরে স্বল্প সময়ে বেশি লাভের স্বপ্ন দেখছেন। এ কারণে গত দুই দশকে অস্বাভাবিক হারে এই গাছে ছেয়ে গেছে রংপুরসহ পুরো উত্তরাঞ্চল। রাস্তা-ঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আবাসভূমি ও কৃষিজমিসহ সবখানেই এর ছড়াছড়ি। যেন দিগন্তজুড়ে ইউক্যালিপটাসের সমারোহ।
কৃষকরা বলছেন, জমির আইলে ইউক্যালিপটাস রোপণ করার পর থেকে খেতে আর পানি থাকে না। দিন দিন ফসলের উৎপাদন কমে যায়। কম সময়ে এই গাছ অনেক বড় হয়। ইউক্যালিপটাস গাছ আশপাশে প্রায় ৫০ ফুট এলাকার পানি শোষণ করে ও আকাশে তুলে দেয়। জমির আইল, কৃষি জমি ও পতিত জমিতে লাগানো এই গাছ উপকারের পরিবর্তে ক্ষতিই বেশি করে।
বর্তমানে কোথাও কোথাও ইউক্যালিপটাস গাছের অত্যাধিক বিচরণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে আসছে বলেও মনে করছেন সচেতন মানুষজন। চলতি শুষ্ক মৌসুমে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে শত শত নলকূপ থেকে পানি উঠছে না। কয়েক হাজার নলকূপে পানি উঠছে একেবারে কম। এতে বিপাকে পড়েছেন এসব এলাকার বাসিন্দারা।
স্থানীয়রা জানান, এখানকার নদীগুলোর প্রায় ৮০ শতাংশ শুকিয়ে গেছে। এছাড়া ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারে কোনো নিয়ম মানা হচ্ছে না। বিশেষ করে যত্রতত্র ইউক্যালিপটাস গাছের বাগান গড়ে তোলা, লাভের আশায় বেশি বেশি চারা রোপণ ও সেচ কাজে ভূগর্ভস্থ পানি তোলায় পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। এতে চাপ পড়ছে অগভীর নলকূপে। বিভিন্ন স্থানে খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। নলকূপ স্থাপন করতে আগে ২০-৩০ ফুট মাটির নিচে পানির স্তর পাওয়া যেত। কিন্তু এখন পানির স্তর মিলছে না ৪০-৫০ ফুট নিচেও।
এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী সাহা আলী বলেন, বিগত বছরগুলোর তুলনায় এ বছর পানির স্তর আরও বেশি নেমে গেছে। এ কারণে এখন সাধারণ দূরত্বের তুলনায় আরও গভীরে নলকূপ স্থাপন করতে হচ্ছে।
ইউক্যালিপটাস গাছ পরিবেশ উপযোগী না হওয়ায় ২০০৮ সালে সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে দেশে ইউক্যালিপটাসের চারা উৎপাদন নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু কৃষকরা না জেনে ইউক্যালিপটাসের চারা রোপণ করছেন। এভাবেই গড়ে উঠেছে শত শত ইউক্যালিপটাসের বাগান। এতে হুমকির মুখে পড়েছে পরিবেশ।
নিষিদ্ধ গাছটির চারা উৎপাদনে সরকারি নিয়ম-নীতির কথা জানেন না স্থানীয় নার্সারি মালিকরা। অন্যান্য বনজ বা ফলদ চারার চেয়ে এই চারা উৎপাদনে ২ থেকে ৩ গুণ বেশি লাভ হয়। এই লোভে তারা বেশি করে চারা উৎপাদন করছেন। ফলে স্কুল-কলেজ-মাদরাসার, বসত-বাড়ি, অফিস-আদালত, রাস্তা-ঘাটে, খেলার মাঠে, হাট-বাজারসহ ফসলের মাঠজুড়ে অন্যান্য ফসলের সঙ্গে ব্যাপকভাবে শোভা পাচ্ছে ইউক্যালিপটাস গাছ। সবকিছু মিলিয়ে বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত হয়ে পড়েছেন বৃক্ষ ও পরিবেশবিদরা।
উত্তর জনপদে ইউকলেক্টর নামে পরিচিতি ইউক্যালিপটাস গাছের চারার অবাধ উৎপাদন, বিপণন ও রোপণ বৃদ্ধির ফলে উত্তরাঞ্চল মরুভূমির দিকে যাচ্ছে। দিন দিন এ অঞ্চলে পানির স্তর কমে আসছে। এক সময়ের বেলে দোঁআশ আর কাঁদা মাটিভরা উত্তরাঞ্চল এখন পানি শুষ্কতায় ভুগছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি জমি ও চাষাবাদ। পরিবেশ ভারসাম্যহীন ইউক্যালিপটাস গাছের কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকিও বাড়ছে।
সাধারণ গাছ প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি প্রাণীকূলের স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসে নাইট্রোজেন গ্রহণ করে আর অক্সিজেন সরবরাহ করে সহায়তা করে। কিন্তু ইউক্যালিপটাস তা করে না। বরং এই গাছ অক্সিজেন গ্রহণ, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ এবং নাইট্রোজেন নির্গমন করে। ইউক্যালিপটাসের পাতা ও ডালপালা অজৈব পদার্থের মতো কাজ করে কৃষি জমিকে অনুর্বর করে। ফলে ফসলের উৎপাদন কমে যায়।
দীর্ঘদিন ধরে, নদী, পাখি ও প্রকৃতি নিয়ে কাজ করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদ। তার ব্যক্তি উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিভিন্ন প্রজাতির ৩৬ হাজারের বেশি গাছগাছালিতে ছেয়ে গেছে।
এই পরিবেশপ্রেমি শিক্ষক বলেন, আমাদের দেশে বর্তমানে বৃষ্টিপাত খুব বেশি হয় না। গ্রামের বেশিরভাগ বড় বড় নদ-নদী বাঁধ দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে দেশের কৃষি জমিগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। এই রকম শুকনো জমিতে ইউক্যালিপটাস গাছটি রোপণ করার মানে নেই। কারণ ইউক্যালিপটাস গাছ প্রচুর পানি শোষণ করে।
তুহিন ওয়াদুদ আরও বলেন, আমাদের জলবায়ুর জন্য ইউক্যালিপটাস গাছ মোটেই উপযোগী নয়। উপরন্তু কৃষি জমি এবং আশপাশের মাটি থেকে অতিমাত্রায় পানি শোষণ করে মারাত্মকভাবে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটাচ্ছে এই রাক্ষুসে গাছ।
এ বিষয়ে রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক ওবায়দুর রহমান মন্ডল বলেন, কৃষি জমির জন্য ইউক্যালিপটাস মারাত্বক হুমকি। পানিখেকো এই গাছ প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ লিটার পানি শোষণ করে মাটিকে নিরস ও শুষ্ক করে ফেলে। ইউক্যালিপটাস গাছ ৫ বছরে ৯২ মিটার লম্বা হতে পারে। মাটির নিচের গোড়ায় ২০-৩০ ফুট জায়গা নিয়ে চারদিকে থেকে ইউক্যালিপটাস পানি শোষণ করে। ফলে অন্যান্য ফলদ গাছের ফলন ভালো হয় না।
তিনি আরও বলেন, ইউক্যালিপটাস পুকুরের পানি দূষণ করে। এ গাছে কোনো পাখি বাসা বাধে না। পাতা সহজে পচে মাটিতে মিশে না। ইউক্যালিপটাস গাছের ফলের রেণু নিঃশ্বাসের সঙ্গে দেহে প্রবেশ করলে অ্যাজমা হয়। এমনকি যে বসত-বাড়িতে অধিক পরিমাণে ইউক্যালিপটাস গাছ আছে সেসব বাড়ির শিশু ও বৃদ্ধদের শ্বাসকষ্ট হতে পারে। আমরা কৃষকদের এই গাছের চারা উৎপাদন, রোপণ ও সরবরাহে নিরুৎসাহিত করছি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের রংপুর বিভাগীয় পরিচালক সৈয়দ ফরহাদ হোসেন বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর সবসময় এ গাছটির বিরোধিতা করছে। আমরা সবসময় এই গাছের ব্যাপারে সবাইকে নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি সভা-সেমিনারে এর বিরুদ্ধে মতামত দিয়ে আসছি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে নার্সারিতে এবং ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যাপক উৎপাদন হচ্ছে। যেহেতু কোনো আইন নেই বা বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়নি তাই এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার পরিবেশ অধিদপ্তরের নেই বলে জানান তিনি।
সামাজিক বন বিভাগের রংপুর বিভাগীয় কর্মকর্তা মতলুবুর রহমান বলেন, আগে থেকেই উত্তরাঞ্চলে ইউক্যালিপটাস গাছের প্রাধান্য রয়েছে। এখন বনবিভাগ এ গাছটি রোপণ করে না। বরং আমরা নিষিদ্ধ করেছি। তবে এখনও ব্যক্তি উদ্যোগে পুরো অঞ্চলজুড়ে বহু মানুষ নিজের জমিতেও ইউক্যালিপটাস রোপণ করছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬:০৯:৫৩ ১৩৩ বার পঠিত