আয়কর আইনকে জাতীয় আইন করার প্রস্তাব করেছে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশ (আইবিএফবি)। সংগঠনের নেতারা বলেন, তবে তা এনবিআর নয়; ভোক্তা, আইন মন্ত্রলাণয় এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে হবে।
শনিবার (৩ জুন) জাতীয় প্রেস ক্লাবে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশ আয়োজিত ‘প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট ২০২৩-২৪ : প্রত্যাশ ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা এসব কথা বলেন।
বক্তব্যে আইবিএফবির প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন রশিদ বলেন, করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে টালমাটাল বিশ্ব অর্থনীতির প্রভাবিত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সুরক্ষা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং টেকসই উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত করতে একটি বহুমুখী, বাস্তবায়নযোগ্য এবং দিক নির্দেশনামূলক বাজেটের বিকল্প নেই। এ প্রেক্ষাপটে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে, যেখানে প্রত্যাশিত জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭.৫ শতাংশ এবং মুদ্রাস্ফীতি হার ৬.০ শতাংশ। এবারের বাজেটের মূল লক্ষ্য হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা ও উচ্চতর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখা।
তিনি বলেন, বাজেট বক্তৃতায় বিগত দেড় দশকের উন্নয়ন অভিযাত্রার সাফল্য গাথা আছে, বিদেশিদেরও প্রশংসার সারমর্ম আছে কিন্তু বর্তমানে দৃশ্যমান চ্যালেঞ্জগুলোর প্রেক্ষাপট পটভূমির কোনো ব্যাখ্যা না থাকায় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ক্ষেত্রে সরকারকে নির্ভার মনে হচ্ছে। বিগত দেড় দশকের সাফল্যকে সাক্ষী রেখে স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার স্লোগান দিয়ে প্রথম বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে নির্বাচনের বছরে। নানা সংকটে নিমজ্জিত অর্থনীতিকে উদ্ধারের দায়কে পাশ কাটিয়ে ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় থাকার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। বিশাল সরকারি ব্যয় বন্ধ বা কম করার উপায়, উপলক্ষ্য ব্যয়, বহুল নতুন নতুন মেগা প্রকল্প শুরু করার ব্যয় বহর দেখে বোঝা যায়, সুশাসন বর্জিত উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হবে। অতি সম্প্রতি মুদ্রার মানদণ্ড অবনমনে বিশ্ব বাণিজ্যে বিনিয়োগে ঋণ কিংবা অনুদান প্রাপ্তিতে পরিস্থিতি সামনে আসার ব্যাপারে কোনো উদ্বেগ বাজেটে নেই।
তিনি আরও বলেন, করোনা মহামারি ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবের ওপর দোষ চাপিয়ে বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় অচল অর্থনীতিকে সচল রাখার, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, করোনা ও যুদ্ধে সৃষ্ট মন্দা মোকাবিলা এবং সম্ভাব্য সুযোগের (কৃষি, স্বাস্থ্য খাত, আইটি, দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার খাতে অধিক মনোযোগ ও দক্ষ জনবল সৃষ্টি) সদ্ব্যবহার ও অনিশ্চিত পরিস্থিতি মোকাবিলার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতীয়মান হয়নি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঘোষিত বাজেটে যেভাবে করোনা ও যুদ্ধের শঙ্কা, অভিঘাত এবং পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করা হয়েছিল, বাজেট বাস্তবায়নে আয়ব্যয় বণ্টনে তার প্রতিফলন হয়নি। বাজেটের আকার, বাজেটের বরাদ্দ, শুল্ককর আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়নি বলে ইতোমধ্যে বিভিন্ন মহলের পর্যবেক্ষণ পর্যালোচনায় উঠে এসেছে।
বাজেটের সার্বিক পর্যালোচনায় আইবিএফবির অভিমত ও সুপারিশ
১. বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ : টেকসই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি ছাড়া কোনো উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কল্পনা করা যায় না। তাই আমদানি নিষেধাজ্ঞার পরিবর্তে আমাদের উচিত বিদেশি অর্থায়নকৃত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নকে গতিশীল করা এবং অস্থির শক্তি ইনপুটগুলোর কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ধাক্কাগুলোর বিরুদ্ধে সুরক্ষা নিশ্চিত করে এবং অর্থ প্রদানের ঘাটতির ভারসাম্য পূরণে সহায়তা করার জন্য একটি বড় আমদানি উপাদান রয়েছে এমন নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পগুলো পুনর্বিবেচনা করা।
২. রপ্তানি আয় বাড়ানোর বিকল্প : ঐতিহ্যগতভাবে একক পণ্য নির্ভর রপ্তানি ঝুড়ির পরিবর্তে, বিদ্যমান নীতির কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য ব্যবসায়/শিল্পের দিকে নীতি সহায়তা প্রসারিত করা উচিত। একটি ব্যবহারকারীবান্ধব প্রক্রিয়া তৈরি করা এবং এই সম্ভাব্য উৎসকে উন্নত করার জন্য আরও জাতীয় তহবিল বরাদ্দ করা উচিত।
৩. আমদানি শুল্ক এবং ন্যূনতম কর : অগ্রিম ট্যাক্সকে কিছু শিল্পের কাঁচামাল আমদানি পর্যায়ে একটি শিল্প উদ্যোগ দ্বারা প্রদত্ত ন্যূনতম কর হিসেবে বিবেচনা করা এবং মোট প্রাপ্তির ওপর স্থির (৫%) ন্যূনতম কর বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের জন্য ক্ষতিকারক হবে, তাই ব্যবসা ও ভোক্তাদের একইভাবে সেরা ফলাফলের জন্য এই প্রস্তাবটি পুনরায় দেখার আহ্বান।
৪. বিদ্যমান সাপ্লাই চেইন অফলোড করার জন্য নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ শুধু আমাদের পরিবেশগতভাবে উপকৃত করে না, বরং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে অবদান রাখে, ক্লিন-এনার্জি প্রযুক্তি সমর্থনকারী সংশ্লিষ্ট শিল্পে বাজার সম্প্রসারণ করে। আমরা অনুকূল উদ্যোগ সুপারিশ করছি।
৫. আয়কর নীতির বৈচিত্র্য : স্বতন্ত্র করের হার, ছাড়, অব্যাহতি এবং ক্রেডিটগুলোর বিভিন্ন নীতি তাদের আয়ের স্তর, আয়ের উৎসের ধরন ও অন্যান্য ব্যক্তিগত পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন করদাতাদের প্রভাবিত করে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) দৃঢ়ভাবে সুপারিশ করছি যাতে করের নেট সম্প্রসারণের দিকে আরও মনোযোগ দিতে একই সময়ে সম্ভাব্য সব স্তরে অটোমেশন গ্রহণ করা যায়। আমরা পুরো প্রক্রিয়াজুড়ে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ই-পেমেন্ট এবং ই-টিডিএস সিস্টেম এবং ডিজিটাল পেমেন্ট ইনসেনটিভ চালু করার ওপর জোর দিতে চাই।
৬. মাথাপিছু দায় হ্রাস করা : উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য দেশিবিদেশি উৎস থেকে ঋণ বা শর্তযুক্ত বাজেট সাপোর্ট সংগ্রহ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা বিচক্ষণ ঋণ ব্যবস্থাপনার কৌশল গ্রহণ করার সুপারিশ করছি।
৭. জলবায়ু দুর্বলতার ওপর কেন্দ্রীভূত প্রকল্প : পরিবেশবিরোধী এবং সবুজ অর্থনীতির ধারণার বিরুদ্ধে যাওয়া সব প্রকল্প পরিত্যাগ করা উচিত। আমরা দৃঢ়ভাবে সুপারিশ করছি জলবায়ু ঝুঁকির ওপর প্রকল্পের জন্য বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে। কেননা, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে অনিয়মিত আবহাওয়ার নিদর্শন অনুভব করছে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন আইবিএফবির ফিন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান মো. আবদুল মজিদ, সাবেক প্রেসিডেন্ট হাফিজুর রহমান খান, ভাইস প্রেসিডেন্ট এম এ সিদ্দিকী প্রমুখ।
বাংলাদেশ সময়: ১৬:০৯:১৮ ১১১ বার পঠিত