হবিগঞ্জের কাকলী খান,সেগুফতা চৌধুরী এবং চমনা চৌধুরী শুধু তিনটি নাম নয়, এরা সরকারের বিভিন্ন প্রযুক্তিগত সেবার সুযোগ নিয়ে, নিজ নিজ শ্রম,মেধা, ধৈর্য্য ও সাধনাবলে আজ প্রতিষ্ঠিত এক একজন স্বনামধণ্যা নারী উদ্যোক্তা। তাদের নারী উদ্যোক্তা হওয়ার নেপথ্য কাহিনী এখন যেন সাফল্যের উৎসগাঁথা হয়ে, হবিগঞ্জের গোটা নারী সমাজের কাছে অনুপ্রেরণার এক জলন্ত দৃস্টান্ত হিসাবেই প্রতিভাত হচ্ছে।
কাকলী খান ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিভাগে ১ম শ্রেণীতে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে চাকুরী নেন অতীশ দিপংকর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন বিভাগে। কিন্তু করোনার কারনে যখন সবকিছু স্থবির, তখন চাকুরী হারাতে হয় কাকলীকে। নিরুপায় হয়ে দুই শিশু সন্তাননে নিয়ে তিনি চলে আসেন হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার বাঘমাড়া গ্রামে স্বামী মাহমুদ খায়ের এর বাড়ীতে। এর পর শুরু করেন অনলাইনে ব্যবসা। উইমেন এন্ড ই কমার্স (উই) এর ফ্লাটফর্ম ব্যবহার করে, তিনি হয়ে যান বড় একজন উদ্যোক্তা। তার পণ্য চা পাতা,খাটি সরিষার তেল, গ্রীণ ট্রি, শতরঞ্জি, নকশিকাথা, মনিপুরী শাড়ী,শাল ও ওড়নাসহ বিভিন্ন পণ্য দেশের সকল জেলায় বিক্রির পাশাপাশি লন্ডন,আমেরিকাসহ ১০/১২টি দেশেও সরবরাহ করছেন। এখন তার হাতে চাকুরীর বেতনের ছেয়েও বেশী অর্থ আসছে।
কাকলী একা নন। তার মতই একজন কর্মজীবি নারী হলেন হবিগঞ্জ শহরের চমনা চৌধুরী। হবিগঞ্জ শহরের পাঠশালা নামে সু-পরিচিত স্কুলের প্রধান তিনি। কিন্তু ২০২০ সালে করোনা আসার পর স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। বেকার হয়ে পড়েন তিনি। বিকল্প চিন্তায় শুরু করেন অন লাইনে ব্যবসা। উই এর ফ্ল্যাট ফর্ম ব্যবহার করে, স্বল্প সময়েই সফলতার স্বাক্ষর রাখেন তিনি।
আর, সেগুফতা চৌধুরী অন লাইন ফ্লাটফর্মে বিক্রি করছেন হবিগঞ্জের বিখ্যাত পণ্য লালিগুড়, পশুশাইল চাউলসহ বিভিন্ন পণ্য। হবিগঞ্জ শহরে এখন তার ব্যাপক পরিচিতি।
শুধু কাকলী, সেগুফতা আর চমনা চৌধুরী নন। তাদেরমত হবিগঞ্জের শতাধিক উদ্যোক্তা অনলাইন ফ্লাটফর্ম ব্যবহার করে সফল উদ্যোক্তা হিসাবে সবার মাঝে সৃষ্টি করেছেন নতুন উদাহরণ। সরকারের নারী বান্ধব নীতিমালা আর ডিজিটাল বাংলাদেশ এর বদৌলতে এখন তারা সফল উদ্যোক্তা। কাকলী, সেগুফতা বা চমনা অনলাইন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে স্বনির্ভরতার যে আলো ছড়িয়েছেন, সেই আলোয় আলোকিত হচ্ছেন হবিগঞ্জের শত শত নারী।
কাকলী খান করোনার সময় চাকুরী হারিয়ে যখন নিরপায় হয়ে পড়েন, তখন তার স্বামী তাকে সান্তনা দেন তার আয়েই চলবে পরিবার। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া কাকলী খান ঘরে বসে গৃহীনি হয়ে বসে থাকবেন, তা চিন্তাই করতে পারেন নি। কিছু একটা করার জন্য অবিমার চেষ্টা চালিয়ে যান। ইন্টারনেটে খুঁজে দেখেন কিছু পাওয়া যায় কিনা। এভাবে তিনি বিভিন্ন নারী উদ্যোক্তার পেইজ দেখতে পান। বিশেষ করে, নারী উদ্যোক্তাদের ফ্লাটফর্ম উই এর সাথে পরিচয় হয় তার। এর পর তিনি নিজেই শুরু করেন অনলাইনে ব্যবসা। এখন তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা। চাকুরীর ছেয়েও বেশী আয় আসে তার। এতে পরিবারেও এসেছে স্বচ্ছলতা। অন্যরাও তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছে। কাকলী খান জানান, ২০১৬ সালে তার বিয়ে হয়। এর পর জন্ম নেয় দুই ছেলে সন্তান। তাদেরকে নিয়েই কষ্ট করে চাকুরী করতেন ঢাকায়। কিন্তু করোনার কারনে চাকুরী হারানোর পর টং শোয়ারী নামে একটি অনলাইন ব্যবসা শুরু করেন তিনি। শ্রীমঙ্গল থেকে সংগ্রহ করেন চা পাতা, গ্রীণ ট্রি, মনিপুরী শাড়ী,শাল এবং ওড়না। সাথে সিলেটের বিখ্যাত শীতলপাটি। ২০২০ সালের জুলাই মাসে যখন ব্যবসা শুরু করেন, তখন খুব একটা কাটতি না থাকলেও মানসম্মত পণ্য সরবরাহের কারনে এখন তার ব্যস্ততার শেষ নেই। এখন মাসে ৭০/৮০ হাজার টাকা আয় আসে তার। লন্ডন,আমেরিকা,সৌদি আরব, গ্রীস আর দুবাইয়ে ডিএইচএল এর মাধ্যমে পার্সেল করে পণ্য সরবরাহ করার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়মিতই সুন্দরবন কুরিয়ারে বুকিং দিতে হয় এসকল পণ্যের। ঢাকা,চট্টগ্রাম ও উত্তরবঙ্গ থেকে অর্ডার আসে বেশী। প্রতিদিন তিনি চুনারুঘাট শহরে এসে পণ্য বুকিং দেন। মাঝে মাঝে স্বামী মাহমুদ খায়েরও বুকিং দিতে নিয়ে যান। আর কারও সহযোগিতার প্রয়োজন হয়না।
কাকলী খান জানান, তার এই সফলতায় স্বামী মাহমুদ খায়েরও আনন্দিত। পরিচিত অনেকেই পরামর্শ নিতে আসে কিভাবে এই ব্যবসা করা যায়। সরকারের নারীর ক্ষমতায়ন এবং প্রত্যন্ত এলাকায় ইন্টারনেটের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক এই এখানে সহজেই সফলতা এসেছে। কাকলী খানের সফলতায় তার ছোট বোন দিনা খানও শুরু করেন অনলাইন ব্যবসা। নাইওয়ারী নামে অনলাইন পেইজ খুলে তিনি বিক্রি করছেন নকশিকাথা, শীতলপাটি আর দেশী শাড়িসহ বিভিন্ন পণ্য। তার পণ্যেরও ব্যাপক কাটতি। মাসে আয় আসে ৪০/৫০ হাজার টাকা। লেখাপড়ার পাশাপাশি অনলাইন ব্যবসায় নিজের সফলতার পাশাপাশি পরিবারে এসেছে স্বচ্ছলতা।
আরেক নারী উদ্যোক্তা দিনা খান জানান, নারীদের এগিয়ে যেতে অনেক বাধা। মার্কেট দোকান দিয়ে মেয়েরা ব্যবসা করবে এমন পরিবেশ এখনও দেশে হয়নি। তবে সরকারের নারীদের এগিয়ে নেয়ার উদ্যোগ আর ডিজিটাল বাংলাদেশ করার প্রত্যয়ের কারনেই আমরা অনলাইনে ব্যবসা করে সফল হতে পেরেছি। আমাদের মত অনেক উদ্যোক্তা ঘরে বসে নিজ নিজ এলাকার বিখ্যাত পণ্যের বিক্রির পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মাঝে অন লাইন ব্যবসা নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করতে স্বক্ষম হয়েছেন।
হবিগঞ্জ শহরের পিটিআই সড়ক এলাকার নারী উদ্যোক্তা সেগুফতা চৌধুরী হোম মেইড খাবার, হোম মেইড কাপড়, খেজুরের রস ও লালিগুড়সহ সিজনাল পণ্য, পশুশাইল চাউলসহ হবিগঞ্জের বিখ্যাত পণ্য বিক্রি করেন তার অনলাইন ‘ঐশি হোম মেইড ফুড’পেইজ থেকে। মাসে লাখ টাকা আয় আসে এই ব্যবসার মাধ্যমে। তিনি জানান, শুরুতে অনেক বাধা ছিল। এখন গ্রাহদের মাঝে আস্থা সৃষ্টি হয়েছে যে, তাদের পন্য খাটি এবং তারা প্রতিশ্রুতি রক্ষা এবং মানসম্মত পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করে। হবিগঞ্জ শহরে এখন সরাসরি অনেকেই তাদের কাছ থেকে পণ্য নিচ্ছে। অনেকেই আগাম বুকিং দিয়ে থাকে। সরকারীভাবে আমাদেরকে প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে। এখন নারীরা ঘরে বসেই সফল হচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতেও নারী উদ্যোক্তারা ভূমিকা রাখছেন।
হবিগঞ্জ শহরের বেবিস্ট্যান্ড এলাকার চমনা চৌধুরী ‘সুরুচি ঘর’ নামক পেইজে বিক্রি করছেন রকমারী শাড়ি ও নারীদের ড্রেসসহ বিভিন্ন পণ্য। শিক্ষকতা পেশার চেয়েও সফলতা এসেছে এই ব্যবসা থেকে। তিনি সরকারী নারীদের এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয়, সেটির মেলবন্ধনেই নারীরা সফল উদ্যোক্তা হতে পেরেছে বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, সরকারীর যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন বিভাগ থেকে প্রশিক্ষণ ও সহায়তা করার কারনেই নারীরা উদ্যোক্তা হতে পেরেছে। একই সাখে উই এর উদ্যোগও তাদেরকে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছে।
উই’র প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার নিশা বলেন, উই এর মাধ্যমে দেশে ১০ লাখের অধিক উদ্যোক্তা কাজ করছেন। এখন নারী উদ্যোক্তারা দেশের প্রত্যন্ত এলাকার পণ্য বিদেশে বিক্রি করছেন। এর মাধ্যমে শুধু কর্মসংস্থান সৃষ্টিই হয়নি। উদ্যোক্তারা দেশের অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রাখছেন।
হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান বলেন, ‘আমরা নারী উদ্যোক্তাদের এগিয়ে নিতে উৎসাহ দিয়ে থাকে। তাদেরকে অন লাইনে সফল হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবসা করা হয়েছে। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থা প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। সরকারও চায় নারীরা সফল হউক। সরকারের নারী বান্ধব নীতি এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় এর জন্যই এখন নারীরা ঘসে বসে বিশ^জয় করতে পারছে। তবে প্রত্যেক নারী উদ্যোক্তাকে সাহসী হতে হবে। যে কোন বিষয়ে হাতে কলমে শিক্ষার বিকল্প নেই। তাই নারী উদ্যোক্তাদের দক্ষ করে সময়োপযোগী করে গড়ে তুলতে বেশি বেশি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সাহসী হয়ে কাজ করলে সাফল্য আসবেই। নানাবিধ শর্তের কারণে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেক আগ্রহী নারী উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণের সুযোগ পায় না। আমরা তাদেরকে সুযোগ সৃষ্টি করে দিব।
বাংলাদেশ সময়: ১৭:১৮:৫৩ ১৫০ বার পঠিত