কাজুবাদাম সম্ভাবনাময়ী একটি অর্থকরী ফসল। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বৃক্ষজাতীয় ফলের মধ্যে এর স্থান তৃতীয়। সেই সঙ্গে বাদামজাতীয় ফসলের মধ্যে এর অবস্থান প্রথম। তামা, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, ভিটামিন ‘কে’ এবং ‘বি’সহ নানা পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ফসল কাজুবাদাম।
দু-বছর আগে ঘোড়াঘাট উপজেলার ১০ জন কৃষকের মাঝে বিনা মূল্যে কাজুবাদামের চারা বিতরণ করেছিল উপজেলা কৃষি বিভাগ। ফেলে রাখা পতিত জমিতে এসব চারা রোপণ করে কৃষকরা। তিন বছরের মাথায় ফল আসার কথা থাকলেও একাধিক বাগানে দু-বছরের মাথায় ফলন এসেছে।
এদিকে পরীক্ষামূলক চাষে সফলতার মুখ দেখেছেন কৃষকরা। প্রথম অবস্থায় কাজুবাদাম চাষে ফলন হওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকলেও বর্তমানে কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে। একাধিক বাগানে থোকায় থোকায় ধরে আছে কাজুবাগাম। বাদামের পাশাপাশি ফুলে ভরা গাছ। শুধু ফল কিংবা ফুল নয়, এরই মধ্যে গাছ থেকে কাজুবাদাম সংগ্রহ শুরু করেছে কৃষক।
এ অঞ্চলের মানুষ কাজুবাদাম গাছের সঙ্গে পরিচিত নয় বললেই চলে। তাই অনেকেই প্রথম দেখায় চিনতে পারছেন না এই কাজুবাদামের গাছ। প্রথম অবস্থায় কাজুবাদাম চাষে ফলন হবে না, এমন আশঙ্কায় এই ফসল চাষকে বোকামি ভাবতেন স্থানীয়রা। তবে গাছে ফলন দেখে খুশি তারা।
উপজেলার পালশা ইউনিয়নে অবস্থিত দুটি বাগান ঘুরে দেখা গেছে, ১০ থেকে ১৫ ফুট উচ্চতার গাছে ধরে আছে সবুজ, হলুদ ও লাল রঙের ফল। এসব ফলের ঠিক নিচেই ঝুলছে কাজু বাদাম। বেশ কয়েকটি গাছের নিচে পড়ে থাকতে দেখা যায় কাজুবাদাম। বাগানের চারপাশে গন্ধ ছড়াচ্ছে কাজু ফল। ঘুরে ঘুরে গাছ থেকে পরিপক্ব কাজুবাদাম সংগ্রহ করছে কৃষি শ্রমিক।
নানা পুষ্টিগুণে ভরপুর এই অর্থকরী ফসল পার্শ্ববর্তী ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিলে দীর্ঘদিন থেকে চাষ হয়ে আসছে। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও খাগড়াছড়িসহ অন্য পাহাড়ি জেলায় চাষ হচ্ছিল এই বাদাম। তবে প্রথমবারের মতো সমতল জেলা দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলায় কাজুবাদাম চাষে সফলতা পেলেন চাষিরা।
নানা পুষ্টিগুণ থাকায় বাংলাদেশসহ বিদেশে কাজুবাদামের ব্যাপক চাহিদা আছে। পাশাপাশি রান্নায় খাবারের স্বাদ বাড়াতেও এই বাদাম ব্যবহারের প্রচলন দীর্ঘদিনের। বিশ্ববাজারে এই বাদামের দামও আকাশচুম্বী। প্রতি ১০০ গ্রাম কাজু বাদামে শর্করা আছে ৩০ দশমিক ১৯ গ্রাম, প্রোটিন ১৮ দশমিক ২২ গ্রাম এবং পানি ৫ দশমিক ২০ গ্রাম। এ ছাড়াও কাজুবাদামে ১২ প্রকারের ভিটামিন এবং ১০ প্রকারের খনিজ পদার্থ আছে।
ঘোড়াঘাট উপজেলার সিংড়া ইউনিয়নের রানীগঞ্জ গ্রামে কাজুবাদাম চাষ করেছেন ফরহাদ মিয়া নামে একজন কৃষক। তিনি বলেন, ‘আমার জমিটি দীর্ঘদিন ধরে অনাবাদি ছিল। কৃষি বিভাগের পরামর্শে দুই বছর আগে আমি কাজুবাদামের চাষ করি। যেহেতু এই ফসল আমাদের এলাকা কিংবা আশপাশে আগে কখনো চাষ হয়নি, তাই ফলন হওয়া নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় ছিলাম। মানুষও বলত, তুমি বোকামি করেছ। তবে কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে তিন বছর দেখব যে ফল হয় কি না, দুই বছরের মাথায় আমার বাগানে ফল এসেছে। আমি হারভেস্ট শুরু করেছি। সত্যি বলতে, আমার নিজের কাছেই অবাক লাগছে।’
গাছে ফল হলেও কাজুবাদাম বাজারজাত করা নিয়ে কিছুটা চিন্তিত কৃষকরা। বিশেষ প্রক্রিয়ায় খোসা ছড়িয়ে বের করতে হয় এই কাজুবাদাম। প্রশিক্ষণ ও বাজারজাতের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায়, কৃষি বিভাগের সহযোগিতা আশা তাদের। অপরদিকে সব ধরনের সহযোগিতা দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে কৃষি বিভাগ।
একই ইউনিয়নের আবিরের পাড়া গ্রামে নিজ বাড়ির পাশে জমিতে কাজু বাগাম চাষ করেছেন আদিবাসী নারী জেস্টিনা হেমরম। তিনি বলেন, ‘প্রথমের দিকে কাজু বাদামের গাছ লাগানো দেখে মানুষ আমাকে পাগল বলত। গাছ যখন ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল তখন অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করত যে এটা কীসের গাছ। দীর্ঘসময় পরিচর্যা করেছি। এ বছর প্রথমবারের মত আমার বাগানে বাদাম ধরেছে। আমি অনেক খুশি। এখন অনেকেই আমার কাছে বিভিন্ন পরামর্শ নিতে আসে এবং কাজু বাদাম চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছে।’
ঘোড়াঘাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রফিকুজ্জামান বলেন, ‘পরীক্ষামূলক চাষে সফলতা এলে ভবিষ্যতে বাণিজ্যিকভাবে কাজুবাদাম চাষ করা হবে। এই কাজুবাদাম বিদেশে রফতানি করে ব্যাপক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। কৃষি বিভাগ প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ফল ও ফসল নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে, নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি নতুন কিছু ফল ও ফসলের পরীক্ষামূলক চাষে সফলতা অর্জন করেছি আমরা।’
বাংলাদেশ সময়: ১৩:১১:৫১ ১৪২ বার পঠিত