প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের ১৪.৩ কিলোমিটার দীর্ঘ কৃত্রিম নৌচলাচল চ্যানেলের উদ্বোধন করেছেন। এই বন্দর দেশের অর্থনীতিতে ২ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার অবদান রেখে অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর এলাকায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী ফলক উন্মোচনের পর বন্দরের প্রথম টার্মিনাল নির্মাণের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে চ্যানেলটির উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রস্তাবিত টার্মিনাল থেকে সমুদ্র পর্যন্ত প্রসারিত চ্যানেলটি জেলার মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ীতে ২০২৬ সালে টার্মিনালটি চালু করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
এ সময় তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ এবং অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
স্বাগত বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (সিপিএ) চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহেল।
চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উভয় স্থানেই এখন বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ। প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়ে বিভিন্ন স্লোগান লেখা পোস্টার, প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন ও ব্যানারে পুরো জেলাশহর সাজিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানিয়েছে কক্সবাজারবাসী।
৪৬০ মিটার দীর্ঘ কন্টেইনার জেটি, ৩০০ মিটার দীর্ঘ বহুমুখী জেটি নির্মাণসহ ১৮.৫-মিটার ড্রাফ্ট (জাহাজের পানির নিচের অংশ) এবং কন্টেইনার ইয়ার্ডসহ বন্দরের বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে আজ থেকে কাজ শুরু হয়েছে।
এই উন্নয়ন কাজ শেষ হলে ৮,০০০ থেকে ১০,০০০ কন্টেইনারবাহী জাহাজ সরাসরি জেটিতে প্রবেশ করতে সক্ষম করবে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সিপিজিসিবিএল ইতিমধ্যে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের অংশ হিসাবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য দুটি জেটি নির্মাণ করেছে এবং এই চ্যানেলের মাধ্যমে ১২০টি জাহাজ চলাচল করতে পারবে।
প্রায় ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ দেশের প্রথম এবং একমাত্র গভীর সমুদ্র বন্দর মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন মেয়াদকাল ২০২৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর।
কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল) মাতারবাড়ী আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ারড পাওয়ার প্রজেক্টের অধীনে তৈরি হওয়ার পর গত ২০ সেপ্টেম্বর চ্যানেলটির দায়িত্ব সিপিএকে হস্তান্তর করে।
মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর চালু হলে দেশের অর্থনীতিতে ২ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার এখান থেকে যোগ হবে এবং সিঙ্গাপুর ও কলম্বো বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনের খরচ ১০ থেকে ২০ শতাংশ কমবে।
বন্দরটি দক্ষিণ এশিয়ার একটি ভিত্তিপ্রস্তর হবে এবং অর্থনৈতিক উন্নতি ও শিল্পায়নের ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা করবে।
এই বন্দরটি বঙ্গোপসাগরের তীরে ১ হাজার ৩১ একর জায়গার উপর নির্মিত হচ্ছে যাতে ৮ হাজার ২০০ টিইইউ ধারণক্ষমতার কন্টেইনার বহনকারী জাহাজ নোঙর করতে পারবে।
মাতারবাড়ী বন্দর উদ্বোধনের পর বন্দরটি দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হবে। কারণ, বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের আর পণ্যের জন্য সিঙ্গাপুর, কলম্বো এবং মালয়েশিয়ার বন্দরে অপেক্ষা করতে হবে না।
তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় একটি পণ্য শিপমেন্ট পাঠাতে ৪৫ দিন সময় লাগে,
বন্দরটি চালুর পরে গন্তব্যে পৌঁছাতে মাত্র ২৩ দিন লাগবে।
গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের লক্ষ্যে ৩৫০ মিটার প্রস্থ এবং ১৬ মিটার গভীরতার ১৪.৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ অ্যাপ্রোচ চ্যানেল নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে।
এছাড়াও, ২ হাজার ১৫০-মিটার ব্রেক ওয়াটার (তরঙ্গ বাধা বাঁধ) নির্মাণ এপ্রোচ চ্যানেলের উত্তর দিকে এবং দক্ষিণ দিকে ৬৭০ মিটার দীর্ঘ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
মাতারবাড়ী টার্মিনাল প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ১৬ মিটার বা তার বেশি গভীরতার জাহাজ বাণিজ্যিকভাবে চলাচলের সুযোগ পাবে।
শেখ হাসিনা এর আগে মাতারবাড়ীতে অন্য একটি কর্মসূচিতে মাতারবাড়ী আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ প্রকল্প (২*৬০০)সহ ১৫টি সমাপ্ত উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন এবং ৫৩ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা ব্যয়ে আরও তিনটি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
প্রকল্পের বিবরণে জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় ২৭ দশমিক ৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করে মাতারবাড়ী বন্দরের সঙ্গে জাতীয় মহাসড়কের সংযোগের কাজও চলছে।
দেশের প্রথম ও একমাত্র গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপনের জন্য ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ২০ লাখ টাকার বেশি ব্যয়ে মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সমুদ্রবন্দর নির্মাণে ব্যয় হবে ৮ হাজার ৯৫৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা।
বন্দর ও সড়ক নির্মাণে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) মাধ্যমে জাপান সরকার মোট ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ঋণ সহায়তা দেবে।
বন্দরটির ২০২৬ সালের মধ্যে আনুমানিক ০.৬ থেকে ১.১ মিলিয়ন টিইইউএস (২০-ফুট কন্টেইনার) এবং ২০৪১ সালের মধ্যে আনুমানিক ২.২ থেকে ২.৬ মিলিয়ন টিইইউএস হ্যান্ডেল করার ক্ষমতা থাকবে।
২০২০ সালের ১০ মার্চ একনেক সভায় মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দেয়াা হয়। প্রকল্পের সময়কাল ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৬ পর্যন্ত।
প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া প্রকল্প এলাকায় সড়ক নির্মাণ করছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ।
মাতারবাড়ীতে অন্য একটি কর্মসূচিতে শেখ হাসিনা আজ মাতারবাড়ী আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ প্রকল্প (২*৬০০) সহ ১৫টি সমাপ্ত উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন এবং ৫৩ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকার অন্য তিনটি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
প্রধানমন্ত্রী সকালে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ব্যয়ে বহুল প্রতীক্ষিত ১০২ কিলোমিটার দীর্ঘ চট্টগ্রামের দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন উদ্বোধন করেছেন, যা রেল যোগাযোগের একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। যা দেশের অর্থনীতিকে এবং সেইসাথে বাণিজ্য, পর্যটন, শিল্প ব্যবসা, ব্যবসা বৃদ্ধির সাথে একটি শক্তিশালী ভিত্তি প্রদানে নতুন আশার সূচনা করেছে।
বাংলাদেশ সময়: ০:০৫:১৬ ১০৯ বার পঠিত