প্রায় সব ধরনের নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে দেশের নির্মাণ শিল্প সংশ্লিষ্ট খাতগুলোতে। ডলার সংকটের কারণে কাঁচামাল আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে দেশে বাড়তি রড সিমেন্টসহ প্রায় সব ধরনের নির্মাণসামগ্রীর দাম। এতে বিপাকে পড়েছেন ভবন নির্মাণে আগ্রহী ব্যক্তি ও ডেভেলপার কোম্পানিগুলো। যার ধাক্কা এসে পড়েছে দেশের রিয়েল এস্টেট খাতেও।
নির্মাণ সামগ্রীর দাম ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় বেড়ে গেছে ফ্ল্যাটের দাম, এতে ফ্ল্যাটের বাজার বর্তমানে মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। ব্যবসায়ীরা জানান, ২০২২ সালে প্রতি টন রডের দাম ছিল ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। বর্তমানে প্রতি টন রডের দাম ওঠানামা করছে কোম্পানিভেদে ৮৮ হাজার থেকে লাখ টাকার মধ্যে।
ডলার সংকট অব্যাহত থাকলে এবং আগামী জানুয়ারিতে নির্বাচন সম্পন্নের পর নির্মাণ খাতের কর্মযজ্ঞ পুরোপুরি শুরু হলে রডের দাম টনপ্রতি লাখ টাকার ঘর ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
নির্মাণসামগ্রীর বাজারে মূল্যস্ফীতির প্রভাব
মূল্যস্ফীতির প্রভাবও পড়ছে নির্মাণসামগ্রীর দামে। সর্বশেষ অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত বিল্ডিং ম্যাটেরিয়াল প্রাইস ইনডেক্স বা বিএমপিআই অক্টোবর মাসে বেড়েছে ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ, যা গত সেপ্টেম্বর থেকে দশমিক ০৯ শতাংশ কম হলেও গত ফেব্রুয়ারির ৬ দশমিক ০৩ শতাংশ থেকে দশমিক ৫৯ শতাংশ বেশি।
এর আগে আগস্ট মাসে বিএমপিআই বেড়েছিল সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ। পরবর্তী দুই মাসের মধ্যে এ খাতে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমে এলেও তা এখনও অনেক বেশি বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
রডের দাম বাড়তির দিকে
বর্তমানে বাজারে কোম্পানিভেদে ’৬০ গ্রেড’ ও ’৫০০ডব্লিউ গ্রেড’ রড বিক্রি হচ্ছে প্রতি টন ৮৮ হাজার থেকে ৯৯ হাজার টাকার মধ্যে। সামান্য কমে বিক্রি হচ্ছে ‘৪০ গ্রেড’ রড। অথচ কয়েক মাস আগেও রডের দাম ছিল কোম্পানি ও গ্রেডভেদে ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকার মধ্যে।
রাজধানীর ইংলিশ রোড আয়রন অ্যান্ড স্টিল মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রচার সম্পাদক ও নয়াবাজার মোড়ে অবস্থিত প্যারাডাইজ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সাজ্জাদ হোসেন সোহেল সময় সংবাদকে বলেন,
বর্তমানে ৬০ গ্রেড ও ৫০০ ডব্লিউ (৭২ গ্রেড) রডের দাম কোম্পানিভেদে প্রতি টন ৮৮ হাজার থেকে ৯৯ হাজার টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে। যেমন ‘৫০০ ডব্লিউ’ গ্রেডের রডের দাম বিএসআরএম এর প্রতি টন ৯৯ হাজার টাকা ও রহিম স্টিল মিলের প্রতি টন ৯২ হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে।
অপরদিকে বন্দর স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ বা বিএসআই-এর ৬০ গ্রেড বিক্রি হচ্ছে প্রতি টন ৮৮ হাজার টাকা, এবং ‘৫০০ ডব্লিউ’ গ্রেড বিক্রি হচ্ছে ৮৯ হাজার টাকায়। অথচ গত বছর একই সময় এই দর ছিল ৮০ হাজার টাকার মধ্যে।
রডের দামে ডলার সংকটের প্রভাব
রডের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ডলার সংকটের কারণে কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলার হার কমার কথা জানালেন এই খাত সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি কাঁচামালের অভাবে মিলগুলো সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছে না বলেও জানান তারা।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও বর্তমান নির্বাহী কমিটির পরিচালক শেখ মাসাদুল আলম মাসুদ সময় সংবাদকে বলেন,
ডলারের দাম বাড়ছে, ইন্টারেস্ট রেট বাড়ছে, মাল প্রয়োজন সাপেক্ষে এলসি করা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে এর একটা প্রভাব তো বাজারের ওপর পড়বেই। কারণ, এই শিল্পের কাঁচামাল পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। এটা যে আরও বাড়বে না এটারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। ডলারের অভাবে এলসি করা যাচ্ছে না, তাই কাঁচামাল আসা কমছে। ফলে মিলগুলো তার সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছে না।
তিনি আরও বলেন, আগে ৫ শতাংশ মার্জিনে কাঁচামাল আমদানি করা যেত, এখন ব্যাংক মার্জিনও বাড়িয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় মূলধনও কমে গেছে। এর ফলে ব্যবসায় তো প্রভাব পড়ছেই, সব মিলিয়ে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বিক্রি ৪০ শতাংশ কমে গেছে।
তবে সামগ্রিকভাবে চাহিদা কিছুটা কমে যাওয়ায় উৎপাদন কমা যাওয়া সত্ত্বেও রডের দাম কিছুটা স্থিতিশীল রয়েছে বলে দাবি করেন মাসাদুল আলম মাসুদ। তিনি বলেন, শীতকাল সামনে রেখে নির্মাণ মৌসুম পুরোদমে শুরু হলে গেলে রডের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়ে দাম আরও বাড়তে পারে।
সিমেন্টের দামও বাড়ছে
রডের পাশাপাশি দাম বাড়ছে সিমেন্টেরও। সিমেন্টের কাঁচামালও আমদানি নির্ভর হওয়ায় ডলার সংকটের প্রভাব পড়ছে দেশের সিমেন্ট শিল্পেও। দাম বাড়ার কারণে চাহিদা কমছে সিমেন্টের, অপরদিকে চাহিদা কম থাকায় মিলগুলোর উৎপাদন সক্ষমতার তুলনায় উৎপাদন কম হওয়ায় বস্তাপ্রতি গড় উৎপাদন খরচ বাড়ছে সিমেন্ট কারখানাগুলোর। এতে লোকসানের সম্মুখীন হওয়ার দাবি জানান সিমেন্ট উৎপাদকরা। বর্তমানে কোম্পানিভেদে ৫০ কেজির সিমেন্টের বস্তা বিক্রি হচ্ছে ৫৪০ থেকে ৫৭০ টাকার মধ্যে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী পরিচালক শঙ্কর কুমার রায় সময় সংবাদকে বলেন,
টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে এই খাতে। কারণ সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল আমদানি নির্ভর। এ কারণে দাম বাড়তির দিকে। তবে আবার দাম বাড়ার কারণে সিমেন্টের চাহিদাও পড়ে গেছে অন্যান্য বছরের তুলনায়। সেই ধাক্কাও পড়ছে উৎপাদকদের কাঁধে।
তিনি বলেন, সক্ষমতার থেকে চাহিদা বর্তমানে অনেক কম। পাশাপাশি নির্মাণ খাতের মৌসুম হিসেবে শীতকালকে ধরা হলেও এবার সিমেন্টের চাহিদা অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক কম। ফলে চাহিদা না থাকায় সক্ষমতা সত্ত্বেও পূর্ণ উৎপাদনে নেই বেশিরভাগ সিমেন্ট কারখানাই। এতে লোকসানের মুখে পড়ার শঙ্কায় রয়েছে কারখানাগুলো। সব মিলিয়ে কোম্পানিগুলো এখন টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত। যেখানে বছরের এ সময় সিমেন্টের চাহিদা ২০ শতাংশের বেশি বেড়ে যায়, সেখানে বর্তমানে এখনও চাহিদা বাড়ার বদলে চাহিদা বরং কমতির দিকে।
নির্মাণ কাজে হাত দিতে অনীহা মধ্যবিত্তের
নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি অপরদিকে হরতাল অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে দেশে নির্মাণ সামগ্রীর চাহিদা কমে গেছে উল্লেখ করে গত বছরের তুলনায় বিক্রি ব্যাপক হারে হ্রাস পাওয়ার কথা জানান এই খাতের খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
এ ব্যাপারে রড ব্যবসায়ী সাজ্জাদ হোসেন সোহেল সময় সংবাদকে জানান,
রড সিমেন্টের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে বর্তমানে ফ্ল্যাটের দাম মধ্যবিত্তদের নাগালের বাইরে। এছাড়া রাজনৈতিক কর্মসূচি ও নির্বাচনের ডামাডোলের কারণে ভবন নির্মাণের কাজে হাত দিতে ভয় পাচ্ছেন অনেকেই বিশেষ করে মধ্যবিত্তরা। যার প্রভাব পড়ছে তাদের বেচাকেনাতেও।
তিনি বলেন, অন্যান্য বছরের একই সময়ের থেকে বর্তমানে তার দোকানে রডের বেচাকেনা ত্রিশ থেকে চল্লিশভাগ কমে গেছে। একই অবস্থা নয়াবাজারের অন্যান্য ব্যবসায়ীদেরও। তবে আগামী জানুয়ারি মাসে নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসলে হঠাৎ করেই দেশে সরকারি বেসরকারি নির্মাণ কাজ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু ডলার সংকট অব্যাহত থাকলে ও চাহিদা বাড়লে তখন রড সিমেন্টের দাম আরেক দফা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ডলার সংকটের প্রভাব আবাসন খাতে
রড সিমেন্টের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে ডলারের দাম বাড়ার কারণে রড সিমেন্টের কাঁচামাল আমদানির খরচ বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করেন দেশের আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি শামসুল আলামিন। সময় সংবাদকে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি ধাপে বেড়ে গেছে কনস্ট্রাকশন ম্যাটেরিয়ালের দাম। একবার দাম বেড়েছিলো ইউক্রেন যুদ্ধের সময়। সে সময় তেলের দাম বাড়ার কারণে, জাহাজ ভাড়া বেড়ে যাওয়ার কারণে আমাদের কাঁচামাল আমদানির খরচ বেড়ে গিয়েছিল। তার পর ডলারের দাম হঠাৎ করে বাড়তে শুরু করার কারণে তার প্রভাবও সরাসরি আমাদের খাতে পড়ে। কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে আমাদের নির্মাণ ব্যয় বেড়ে গেছে।
এদিকে নির্মাণ ব্যয় বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে আবাসন খাতের ফ্ল্যাটের দামও বেড়ে গেছে স্বীকার করে এর প্রভাবে রিয়েল এস্টেট সেক্টরে মন্দাভাব বিরাজ করছে বলে জানান শামসুল আলামিন। তিনি বলেন,
ভবন নির্মাণ সামগ্রীর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি উপাদান হচ্ছে রড ও সিমেন্ট। রড ও সিমেন্টের দাম ব্যাপক হারে বেড়েছে। রড সিমেন্টের দাম বাড়ার সরাসরি প্রভাব পড়ছে এই খাতে। নির্মাণ ব্যয় বেড়ে যাওয়ার ফলে ফ্ল্যাটের দাম বেড়ে গেছে। এর ফলে তা আমাদের মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। যে কারণে বর্তমানে বাজারের গতি কমে এসেছে। পাশাপাশি নির্বাচন সামনে চলে আসায় মানুষ কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছে। ফলে সব মিলিয়েই এখন বাজারে কিছুটা মন্দাভাব বিরাজ করছে।
এছাড়া নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধির জেরে আবাসন ব্যবসায়ীরা চুক্তিপত্রে উল্লিখিত দামের মধ্যে ক্রেতাদের ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিতে হিমশিম খাচ্ছেন বলেও জানান রিহ্যাব সভাপতি। এতে লোকসানের শিকার হতে হচ্ছে আবাসন ব্যবসায়ীদের।
শামসুল আলামিন বলেন, নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়ার কারণে ডেভেলপারদের সঙ্গে ক্রেতাদের ঝামেলার সৃষ্টি হচ্ছে। কারণ সাধারণত একটি মূল্য নির্ধারণ করে ক্রেতাদের কাছে বিক্রির পরই ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেন ডেভেলপাররা। কিন্তু চুক্তির পর দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে পূর্বের দামের সঙ্গে সমন্বয় করে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা এতে লাভ তো দূরের কথা উল্টো লোকসানের মুখে পড়ছেন রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ সময়: ১২:৪২:৪১ ৮৭ বার পঠিত