বাজার নিয়ন্ত্রণে চাল, খেজুর, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, আলু ও ডিম আমদানিতে শুল্ক ছাড় দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু ডিমের দাম কমলেও বাকি ৬ পণ্যের দাম কমেনি আশানুরূপভাবে। কমার বদলে উল্টো বেড়ে গেছে কোনো কোনোটির দাম।
দেশে নিত্যপণ্যের বাজার লাগামহীন। এতে দিশেহারা ভোক্তারা। সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে ও বাজারে নিয়ন্ত্রণ আনতে গত ৭ অক্টোবর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার ও সরবরাহ পরিস্থিতি তদারকি এবং পর্যালোচনার জন্য জেলা পর্যায়ে ১০ সদস্যের বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এছাড়া নিয়মিত বাজারে অভিযান চালাচ্ছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থা। পাশাপাশি বাজার নিয়ন্ত্রণে ৭টি পণ্যের আমদানি শুল্কে ছাড়ও দেয়া হয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি এবং শুল্কছাড়ে কেনা অধিকাংশ পণ্য দেশে এসে না পৌঁছানোয় কমছে না এসব পণ্যের দাম।
ভোজ্যতেল
বাজারে ভোজ্যতেলের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে গত ১৭ অক্টোবর পরিশোধিত সয়াবিন তেল ও পরিশোধিত পাম তেল সরবরাহের ক্ষেত্রে স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে আরোপিত ১৫ শতাংশ এবং স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে আরোপিত ৫ শতাংশ মূসক অব্যাহতি দিয়েছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এছাড়া, অপরিশোধিত সয়াবিন তেল, অপরিশোধিত পাম তেল ও পরিশোধিত পাম তেলসহ অন্যান্য পরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি পর্যায়ের মূসক ১৫ শতাংশের পরিবর্তে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল।
তবে এতে দাম নিয়ন্ত্রণের বদলে উল্টো বাড়তে শুরু করে। ফলে গত ১৯ নভেম্বর ভোজ্যতেলের ওপর প্রযোজ্য আমদানি পর্যায়ের মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়।
বর্তমানে দাম কিছুটা কমলেও তা বিক্রি হচ্ছে শুল্ক হ্রাসের আগের চেয়ে বেশি দামে। বর্তমানে বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৬৫-১৬৮ টাকা, আর খোলা পাম তেল ১৫৭-১৬০ টাকা। এর আগে, দুদফা শুল্ক কমানোর আগে যথাক্রমে বিক্রি হয়েছিল ১৫৬ টাকা ও ১৪৬ টাকায়।
তবে কমেছে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ। কোম্পানি তেল দিচ্ছে না, এমন অভিযোগ করছেন ব্যবসায়ীরা।
আলু
গত ৫ সেপ্টেম্বর এক প্রজ্ঞাপনে এনবিআর জানায়, আলু আমদানিতে বিদ্যমান ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে আলু আমদানিতে যে, ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আছে, তা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে। আলু আমদানিতে এ শুল্ক সুবিধা বহাল থাকবে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত।
এতে সে সময় বাজারে কেজিপ্রতি ৫ টাকা কমলেও বর্তমানে আবার দাম বেড়ে সে আলু প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭৫-৮০ টাকা। বাজারে নতুন আলু উঠতে শুরু করলেও তার প্রভাব পড়েনি দামে। নতুন আলু বিক্রি হচ্ছে ১০০-১২০ টাকা কেজিতে।
পেঁয়াজ
গত ৫ সেপ্টেম্বর এক প্রজ্ঞাপনে এনবিআর জানায়, পেঁয়াজ আমদানিতে বিদ্যমান ৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। এতেও বাজার নিয়ন্ত্রণে না এলে গত ৬ নভেম্বর পেঁয়াজ আমদানিতে শুল্ক-কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে এনবিআর। এ সুবিধা ২০২৫ সালের ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বহাল থাকবে।
তবে বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, দাম কমলেও এখনও তা বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকার ওপরে। বর্তমানে খুচরায় প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ১১৫-১২০ টাকা ও ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৯৫-১০০ টাকায়।
বিক্রেতারা বলছেন, পেঁয়াজের কালি ওঠায় এবং আমদানি করা পেঁয়াজের সরবরাহ বাড়ায় দাম কমতে শুরু করেছে পণ্যটির। তবে নতুন দেশি পেঁয়াজ বাজারে আসার আগ পর্যন্ত দাম ১০০ টাকার নিচে নামার সম্ভাবনা কম।
চাল
দেশের চালের বাজারে স্বস্তি ফেরাতে গত ২০ অক্টোবর চালের ওপর বিদ্যমান আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ, বিদ্যমান রেগুলেটরি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ এবং বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করেছিল এনবিআর। এতে দাম না কমলে গত ৩১ অক্টোবর চাল আমদানিতে শুল্ক পুরোপুরি তুলে নিয়েছে সরকার।
বর্তমানে বাজারে আসতে শুরু করেছে নতুন পাইজাম ও আটাশ চাল। তবে পর্যাপ্ত পরিমাণে না আসায় বাজারে তেমন প্রভাব পড়েনি, আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে চাল।
বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি মিনিকেট ৭০-৭২ টাকা, আটাইশ ৬০-৬২ টাকা, নাজিরশাইল ৭৬-৮২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীর কারওয়ানবাজারের বরিশাল রাইছ এজেন্সির বিক্রেতা জানান, নতুন করে আর না বাড়লেও চালের দাম কমেনি। বাজারে প্রতি কেজি মিনিকেট ৭০-৭২ টাকা, আটাইশ ৬০-৬২ টাকা, নাজিরশাইল ৭৬-৮২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে নতুন পাইজাম ও আটাশ চাল বাজারে আসতে শুরু করেছে। সামনে দাম কমতে পারে।
চিনি
গত ৮ অক্টোবর পরিশোধিত ও অপরিশোধিত চিনির ওপর বিদ্যমান নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করেছে এনবিআর। নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৫০ শতাংশ হ্রাস করা সত্ত্বেও বাজারে পরিশোধিত চিনির সরবরাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এক সপ্তাহের মধ্যে পুনরায় পরিশোধিত চিনির ওপর বিদ্যমান আমদানি শুল্ক প্রতি মেট্রিক টন ৬ হাজার টাকা থেকে কমিয়ে প্রতি মেট্রিক টন ৪ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করেছে।
এতে বাজারে কমতে শুরু করেছে দাম। বর্তমানে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১২৫-১৩০ টাকায়, যা গত সপ্তাহে ছিল ১৩০-১৩৫ টাকা।
ডিম
ডিমের অস্থির বাজার নিয়ন্ত্রণে গত ১৭ সেপ্টেম্বর আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয় এনবিআর। এ অব্যাহতি সুবিধা চলতি বছরের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
এর পাশাপাশি অভিযান, সভা ও ডিম আমদানিসহ নানা নাটকীয়তার পর স্বস্তি ফিরেছে ডিমের বাজারে। বিক্রি হচ্ছে সরকার নির্ধারিত দামে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, উৎপাদক পর্যায় থেকে কম দামে ডিম কিনতে পারলে পাইকারি ও খুচরা বাজারেও নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করা সম্ভব হবে। বর্তমানে প্রতি ডজন লাল ডিম খুচরা পর্যায়ে ১৪৪-১৪৫ টাকা ও সাদা ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৪৪ টাকা।
খেজুর
পবিত্র রমজান মাসেই অনেকের ইফতারের তালিকায় বেশি চাহিদা থাকে খেজুরের। তাই সে সময় বাড়ে দাম। তবে এবার বছরের শুরু থেকেই চড়া পণ্যটির দাম। ফলে আসন্ন রমজানে দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে খেজুর আমদানিতে শুল্ক ও অগ্রিম কর কমানোর পাশাপাশি আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, খেজুর আমদানির ওপর বিদ্যমান কাস্টমস ডিউটি ২৫ শতাংশ হতে কমিয়ে ১৫ শতাংশ, অগ্রিম আয়কর ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ এবং বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে। অর্থাৎ মোট করভার ৬৩ দশমিক ৬০ শতাংশ হতে কমিয়ে ৩৮ দশমিক ৭০ শতাংশ করা হয়েছে। এই সুবিধা ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
তবে বাজার ঘুরে দেখা যায়, শুল্ক কমানোর পরও কমেনি দাম। বাজারে প্রতি কেজি দাবাস খেজুর ৪৮০ টাকা, খুরমা খেজুর ৩৮০ টাকা, আজওয়া খেজুর ১ হাজার ১০০ টাকা, জাহিদি খেজুর ২৮০ টাকা, বরই খেজুর ৪৪০ টাকা, মরিয়ম খেজুর ১ হাজার ৪৫০ টাকা ও মেডজুল খেজুর বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৫০০ টাকায়।
বাজারের যখন এ পরিস্থিতি তখন ভোক্তারা বলছেন, শুধু আমদানি শুল্ক হ্রাস বা বিদেশ থেকে পণ্য আনলেই হবে না, দাম নিয়ন্ত্রণে করতে কঠোর বাজার মনিটরিংও দরকার।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ক্যাব বলছে, ব্যবসায়ীদের মানসিকতার পরিবর্তন না হলে কাজে আসবে না কোনো উদ্যোগই। সম্প্রতি সময় সংবাদকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ক্যাব সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, বাজারে ঊর্ধ্বমুখী প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম। এটি গত সরকারের সময় থেকেই বাড়তি। সরকার পতনের পর মাঝে এক সপ্তাহ দাম কমলেও এখন আবার সেটি চড়া। কারণ সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ীরা পোশাক বদলেছে, কিন্তু চরিত্র বদলায়নি। তারা আগের মতোই কারসাজি করে যাচ্ছে।
রোজায় পণ্যের দাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকার দাম কমানোর জন্য পণ্য আমদানি ও শুল্ক ছাড় দিচ্ছে। কিন্তু বাজারে পর্যাপ্ত মনিটরিং হচ্ছে না। প্রতিবারই এরকম হয়ে থাকে। সরকার নানা পদক্ষেপ নেয় দাম কমানোর, তবে মনিটরিংয়ের জায়গায় ঘাটতি থেকে যায়। বাজার নিয়ন্ত্রণে পণ্য আমদানি থেকে শুরু করে ভোক্তার হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত মনিটরিং করতে হবে। না হলে সুফল মিলবে না।
রোজায় মনিটরিং না বাড়ালে অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াতে হুমড়ি খেয়ে পড়বে জানিয়ে নাজের হোসাইন বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা সারা বছরের লাভ এক মাসে উঠানোর চেষ্টায় থাকেন। ফলে রমজানে বেড়ে যায় পণ্যের দাম। ব্যবসায়ীদের এ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসার অনুরোধ করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১২:০২:৩১ ৩২ বার পঠিত