স্বপ্নের ফেরি চালু হওয়ায় উচ্ছ্বসিত সন্দ্বীপের চার লাখ বাসিন্দা

প্রথম পাতা » চট্টগ্রাম » স্বপ্নের ফেরি চালু হওয়ায় উচ্ছ্বসিত সন্দ্বীপের চার লাখ বাসিন্দা
সোমবার, ২৪ মার্চ ২০২৫



স্বপ্নের ফেরি চালু হওয়ায় উচ্ছ্বসিত সন্দ্বীপের চার লাখ বাসিন্দা

উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে দেশের মূল ভূখণ্ডে পৌঁছানোই চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের মানুষের নিত্যদিনের সংগ্রাম। সেই সন্দ্বীপ থেকে এবার বাস ছুটবে ঢাকা-চট্টগ্রামের পথে। ফেরিতে চেপে সাগর পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন পূরণ হলো সন্দ্বীপের বাসিন্দাদের। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর চলাচলে দুর্ভোগের ইতি ঘটেছে সন্দ্বীপবাসীর।

বিচ্ছিন্ন এ দ্বীপটিতে আজ সোমবার (২৪ মার্চ) সকালে উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে স্বপ্নের ফেরি চলাচল। এর মাধ্যমে দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের চার লাখ বাসিন্দার দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে। ফেরি সার্ভিসের উদ্বোধনের পর সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া, এনামনাহার, সেনেরহাট ও উপজেলা সদরের সড়কজুড়ে দেখা গেছে মানুষের আনন্দ ও উচ্ছ্বাস।

ফেরি সার্ভিস উদ্বোধন উপলক্ষে সোমবার (২৪ মার্চ) সকাল ১১টায় সন্দ্বীপ উপজেলা পরিষদ চত্বরে আয়োজিত সুধী সমাবেশে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস।

সমাবেশে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশের কোনো উন্নয়নই সফল হবে না, যদি প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি না হয়। ফেরি চালুর আগে নৌঘাট দখলমুক্ত করতে হয়েছে। সমুদ্র উপকূল হওয়ায় এটি বাস্তবায়ন করা কঠিন ছিল।’

তিনি বলেন, সন্দ্বীপ বাংলাদেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী একটি দ্বীপ। দেশের বিভিন্ন জায়গায় উন্নতি হলেও স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর্যন্ত এ দ্বীপ উপকূলটি অবহেলিত অবস্থায় রয়ে গেছে। আজ ফেরি সেবা চালুর মধ্যদিয়ে দ্বীপবাসী একটি কলঙ্ক থেকে মুক্তি পেলো।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত সন্দ্বীপের শহীদ মাহমুদুর রহমান সৈকত ও সাইমুন হোসেন মাহিনের নামে দুটি ফেরিঘাট নামকরণ করার জন্য নৌপরিবহণ উপদেষ্টা প্রস্তাব দেন। এসময় উপস্থিত সুধীজন সমস্বরে হ্যাঁ সূচক জবাব দিয়ে ঘাটের নামকরণকে স্বাগত জানান। অনুষ্ঠানে এ দুই শহিদ পরিবারকে ১০ লক্ষ টাকা করে অনুদানের চেক প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে এ পরিবারদ্বয়কে আরো ২০ লাখ করে অনুদান প্রদান করা হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘এই ফেরি চালুর মূল কৃতিত্ব প্রধান উপদেষ্টার। গত আগস্টে একটা ভিডিও দেখিয়ে তাকে জানাই, কাদা-মাটি পেরিয়ে সন্দ্বীপের নারীদের পারাপার হতে হয়। তিনি বলেছিলেন, এটা হতে পারে না, সমাধান করতেই হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এটি একটি দুরূহ প্রকল্প, কারণ বাংলাদেশে সামুদ্রিক ফেরি চালানোর পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জ আমরা সফলভাবে মোকাবিলা করেছি।’

নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ ইউসুফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন- পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বীর প্রতীক, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. খোদা বখস চৌধুরী, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান, চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ড. জিয়াউদ্দিন ও জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম।

স্বাগত বক্তব্য দেন বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা।

এর আগে সকাল সাড়ে ৮টায় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বাঁশবাড়িয়া জেটি ঘাট-১ এ বিআরটিসি বাসের উদ্বোধন করেন সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। এরপর সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়ায় নবনির্মিত ফেরি পল্টুন ও ফেরি চলাচলের উদ্বোধন করেন নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন।

এরপর সকাল ৯টায় সন্দ্বীপের উদ্দেশ্যে ফেরি ‘কপোতাক্ষ’ যাত্রা শুরু করে। সকাল ১০টায় সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাটে ফেরি পৌঁছানোর পর স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁদের স্বাগত জানান। ফেরি থেকে নেমে গুপ্তছড়া ঘাটের নামফলক উন্মোচন করেন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন। এসময় অন্যান্য অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন।

সন্দ্বীপকে নৌবন্দর ঘোষণা, গুপ্তছড়া ও কুমিরাঘাট উন্মুক্ত করা এবং ঢাকা-সন্দ্বীপ বাস সার্ভিস চালু করা, ফেরিঘাট এলাকায় সংযোগ সড়ক নির্মাণ, নৌপথে ড্রেজিং এর উদ্যোগগুলো সন্দ্বীপবাসীর দীর্ঘদিনের ভোগান্তি থেকে তাদের মুক্ত করবে বলে উপদেষ্টাগণ আশা প্রকাশ করেন।

সন্দ্বীপ সদরের ব্যবসায়ী মো. ফারুখ হোসেন বলেন, শত বছর ধরে উত্তাল সাগরপথে স্পিডবোট ও ট্রলারসহ বিভিন্ন নৌযানে চলাচল করতেন এই দ্বীপের বাসিন্দারা। বিরূপ পরিবেশে বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনায় ঘটতো প্রাণহানি। যাত্রাপথে কখনো কোমর পানি, কখনো হাঁটু পানি ও কাদা মাড়িয়ে ফিরতে হতো আমাদের। বেশি দুর্ভোগে পড়তে হতো নারী ও শিশুদের। সূর্যাস্তের পর বন্ধ হয়ে যেত যোগাযোগ ব্যবস্থা। ফেরি চলাচল শুরু হওয়ায় দ্বীপবাসীর চলাচলে নতুন যুগের শুরু হলো। সন্দ্বীপের চার লাখ বাসিন্দাদের মাঝে আজ এক মহা আনন্দ বয়ে যাচ্ছে।

দক্ষিণ সন্দ্বীপের জেবেননুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক কাজী আনোয়ার হোসেন জানান, চারপাশে জলরাশিঘেরা সন্দ্বীপ মাত্র ৭৫০ বর্গকিলোমিটারের একটুকরা ভূখণ্ড। এ অঞ্চলের প্রায় চার লাখ বাসিন্দার যাতায়াত ব্যবস্থার জন্য রয়েছে কুমিরা-গুপ্তছড়াসহ ছয়টি নৌপথ। একটিমাত্র যাত্রীবাহী জাহাজে মানুষ যাতায়াত করতেন এত দিন।

পাশাপাশি স্পিডবোট, কাঠের ট্রলারে ঝুঁকি নিয়ে যাত্রী পারাপার হতো। ঘটত অনেক দুর্ঘটনা। ছিল কাদা মাড়িয়ে হাঁটার দুর্ভোগ। ফেরি চালু হওয়ায় এসব দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পেল সন্দ্বীপের বাসিন্দারা।

স্থানীয় বাসিন্দা অ্যাডভোকেট আরিফ হোসেন বলেন, ফেরি চলাচল সন্দ্বীপবাসীর অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ। এর সুফল ভোগ করার জন্য সন্দ্বীপবাসী অধীর আগ্রহে মুখিয়ে আছে। নিরবচ্ছিন্ন সেবা প্রদানের জন্য বাস্তবমুখী সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করে স্থায়িত্বশীল সেবা নিশ্চিত করা হলে প্রকৃত অর্থে যাতায়াত তথা আর্থিকভাবে সন্দ্বীপের মানুষের ব্যাপক কল্যাণ সাধিত হবে।

ফেরি সার্ভিসের সাথে একত্রে, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন (বিআরটিসি) চট্টগ্রাম বিমানবন্দর, সি বিচ, নিমতলা, নয়াবাজার, কুমিরা, বাঁশবাড়িয়া ফেরি ঘাট এবং সন্দ্বীপ এনাম নাহার মোড়ের সাথে সংযোগকারী একটি এসি বাস সার্ভিস চালু করেছে।

দ্বীপের বাসিন্দা এহসানুল হক বলেন, এবার সন্দ্বীপবাসীর ঈদও কাটবে ভিন্নভাবে। দ্বীপবাসীর স্বপ্নের ফেরি সার্ভিস চালু হয়েছে। এবার লোকজন ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে সন্দ্বীপে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে পারবে। এটি কতটা আনন্দের দ্বীপবাসীরাই জানবে।

ফেরি সার্ভিসের জন্য উভয় প্রান্তে নতুন রাস্তা, পার্কিং সুবিধা এবং ফেরি পিয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। একটি ফেরি রুট চালুর আগে বেশ কয়েকটি ট্রায়াল রান পরিচালিত হয়েছিল।

এই উন্নয়নের ফলে, বাস, ট্রাক, ট্যাংক লরি, মিনিবাস এবং প্রাইভেট কারসহ সব ধরনের যানবাহন এখন সরাসরি সন্দ্বীপে যেতে পারবে। এই মাইলফলকটি জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে এবং দ্বীপের বাসিন্দাদের অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে অংশগ্রহণ বাড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে।

আইডব্লিউটিএ’র কর্মকর্তারা জানান, বাঁশবাড়িয়া থেকে ছেড়ে সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাটে যেতে প্রায় এক ঘণ্টা দশ মিনিট সময় লাগবে। জোয়ারভাটা সাপেক্ষে প্রতিদিন চারটি ফেরি ট্রিপ দিবে। এবং প্রতিটি ফেরিতে বিভিন্ন আকারের প্রায় ৩৫টি যানবাহন চলাচল করতে পারে। ফেরিতে গাড়িসহ ৬০০ যাত্রী বহন করা সম্ভব বলেও জানিয়েছেন তারা।

বাংলাদেশ সময়: ২৩:৫৫:৪৩   ১৯ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

চট্টগ্রাম’র আরও খবর


এখন আরেক দল শেখ হাসিনার মতো ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে : আমীর খসরু
ঈদযাত্রা নিরাপদে রাখতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে র‌্যাবের টহল-তল্লাশি
আরাকান আর্মি হাতে আটক ৬ জেলে দেশে ফিরলেন
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিপুল পরিমাণ ভারতীয় মদসহ পিকআপভ্যান জব্দ
ছিনতাই-ডাকাতির শঙ্কা: চট্টগ্রামে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা
দেশে প্রতিদিন গণতন্ত্রহীন পরিস্থিতি বিরাজ করছে : আমীর খসরু
স্বপ্নের ফেরি চালু হওয়ায় উচ্ছ্বসিত সন্দ্বীপের চার লাখ বাসিন্দা
ছাত্রীকে অপহরণ করে ধর্ষণ, ৪ বছর পর গৃহশিক্ষক গ্রেপ্তার
চারগুণ মাশুল আদায়ের সিদ্ধান্তে মুখোমুখি চট্টগ্রাম বন্দর ও বিজিএমইএ
খাগড়াছড়িতে দুই দুর্ধর্ষ ডাকাত গ্রেফতার, লুণ্ঠিত মালামাল ও সরঞ্জাম উদ্ধার

News 2 Narayanganj News Archive

আর্কাইভ