গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ইয়াবা প্রাসাদ

প্রথম পাতা » চট্টগ্রাম » গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ইয়াবা প্রাসাদ
সোমবার, ২৮ জানুয়ারী ২০১৯



---

বাংলাদেশের সবচেয়ে পূর্বদিকের উপজেলা টেকনাফ। রাজধানী থেকে প্রায় ৫শ কিলোমিটার দূরের প্রত্যন্ত এ উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা এক সময় ছিল খুবই নাজুক। পর্যটনশিল্পে অগাধ সম্ভাবনাময় হওয়ায় সরকারের সুদৃষ্টির সুবাদে টেকনাফের যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। তবে পাহাড়শ্রেণি ও নদীবাহিত এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষই দরিদ্র।

এ অঞ্চলের বসতিগুলোতেও রয়েছে এই দারিদ্র্যের ছাপ। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই টেকনাফে দেখা গেল ব্যাপক পরিবর্তন। কিছু মানুষ হঠাৎ ব্যাপক ধন-সম্পদের মালিক বনে গেল; টেকনাফ পৌরসভার আশপাশে একটি দুটি করে গড়ে উঠল শত শত সুরম্য অট্টালিকা। কীভাবে সম্ভব হলো? এ অঞ্চলের কিছু মানুষ আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ হাতে পেয়েছে? নাকি রূপকথার বড় কোনো জাদুকরের সান্নিধ্য? এসব প্রশ্নের ছোট্ট উত্তর, ইয়াবা কারবার।

ইয়াবা কারবার শুরু হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যে টেকনাফ পৌরসভার আশপাশের গ্রামগুলোতে রাতারাতি সুরম্য অট্টালিকা গড়ে ওঠে। দুই শতাধিক অট্টালিকা থেকে ইতিমধ্যে অন্তত ৩০টি বাড়ি সীমানা দেওয়াল গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এসব বাড়ি কিংবা সীমানা দেওয়াল ভেঙে দেওয়ার ঘটনায় কোনো বাড়ির মালিকই থানায় কিংবা অন্য কোথাও কোনো ধরনের অভিযোগ করেননি।

গত দুদিন টেকনাফ পৌরসভা, পার্শ্ববর্তী টেকনাফ সদর ইউনিয়ন ও সাবরাং ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, বাড়িগুলো যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিস্থিতির সাক্ষ্য হয়ে আছে। এসব বাড়ির সামনে এখন আর আশপাশের মানুষ দাঁড়ায় না। উল্টো কেউ ছবি তুলতে গেলে সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায়। বাড়িগুলোর বেশিরভাগই এখন জনশূন্য। তবে বাইরে থেকে দেয়াল ও বাড়ির সীমানা দেয়াল ভেঙে দেওয়া হলেও বাড়ির ভিতরের দামি ফিটিংস, টাইলস, ডুপ্লেক্স ডিজাইন অক্ষুণœ রয়েছে। টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, বাড়িগুলো তৈরির ক্ষেত্রে নকশা ও উন্নত যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বিপুল অর্থ ব্যয় করেছে ইয়াবা কারবারিরা।

কারা এসব বাড়ি ভেঙেছে? এমন প্রশ্নে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্য কোনো বাহিনী কিংবা সরকারি কোনো কর্মকর্তা মুখ খুলছেন না। কিন্তু রাত গভীর হলে রীতিমতো বুলডোজার, হাতুড়ি ও পাকা ঘর ভাঙার যন্ত্রপাতি নিয়ে একদল লোক ওইসব বাড়িঘর ভাঙা শুরু করে। তারা একটি বাড়ি ভাঙতে টানা তিন থেকে চারঘণ্টা সময় নেয়; ভোর হলে চলে যায়।

সরেজমিন ঘুরে ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যারা আসেন, তাদের সবাই মুখোশে ঢাকা। আসেন মাইক্রোবাস নিয়ে। সঙ্গে আনে বুলডোজার। কারা ভাঙছেন এসব অট্টালিকা আর বিলাসবহুল বাড়ি? তা পুরোপুরি স্পষ্ট করে কেউ না বললেও অনেকেরই ধারণা, পুলিশই এসব করাচ্ছে। স্থানীয়দেরও এমনই বিশ্বাস। তারা মনে করেন, পুলিশই ইয়াবার বিত্তে দৃশ্যমান বৈভবসমূহ গুঁড়িয়ে দেওয়ার কাজটি তদারক করে। স্থানীয়দের প্রশ্ন, পুলিশের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ছাড়া দিনে-রাতে এভাবে কারও বাড়ি ভাঙা কখনো সম্ভব?

কক্সবাজারের একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, একটি বাড়ি ভেঙে দিলে একজন ইয়াবা কারবারি আর্থিকভাবে খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তবে নৈতিক ও কৌশলগতভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে; মানসিকভাবে ভেঙে পড়বে। এ থেকে অন্য কারবারিরাও একটি বার্তা পাবে। এমন ভাবনা থেকে বাড়িগুলো ভাঙার কাজে সহযোগিতা করছে পুলিশ।

টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ আমাদের সময়কে বলেন, ইয়াবা কারবারিদের প্রতি স্থানীয় মানুষের ক্ষোভ ও ঘৃণা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। তাদের কারণে স্থানীয় সাধারণ মানুষ বাজার থেকে মাছ-মাংস কিনে খেতে পারত না। মসজিদ মাদ্রাসার কমিটির সভাপতিও এসব ব্যক্তিদের করতে হতো, কারণ তাদের টাকার জোর ছিল। এসব ক্ষোভ থেকে স্থানীয় লোকজনই রাতের অন্ধকারে দলবদ্ধ হয়ে এসব বাড়িতে হামলা চালাচ্ছে। এতগুলো বাড়ি ভাঙার পরও কেউ থানায় এসে অভিযোগ করেননি।

এ পর্যন্ত যাদের বাড়িঘর ভাঙা হয়েছে তারা হলেন-হ্নীলা ফুলের ডেইল ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য শামসুল আলম বাবুল, পশ্চিম সিকদারপাড়া এলাকার আবু বক্কর আল মাসুদ, হ্নীলা স্টেশনের এনায়েত করিম সামি, পূর্ব পানখালীর দেলোয়ার হোসেন বগা, হ্নীলা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নুরুল হুদা, একই ওয়ার্ডের তিন ভাই যথাক্রমে-মোহাম্মদ আলম, মোহাম্মদ জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম, টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড নাজিরপাড়া এলাকার ইউপি সদস্য এনামুল হক, সাবেক ইউপি সদস্য সৈয়দ হোসেন, নাজিরপাড়ার নুরুল হক ভুট্টো, চান মিয়া, মৌলভীপাড়ার আবদুর রহমান ও তার ভাই মোহাম্মদ একরাম, হাবিরপাড়া সিদ্দিক আহমদ, শিলবুনিয়াপাড়া সাইফুল করিম, সাবরাং ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন দানু।

টেকনাফ পৌরসভার জালিয়াপাড়ার মো. সালমান, মোস্তাক আহমদ মুসু, মো. হাসান আলী, আনকু, নাজমুল, জুবায়ের, মোজাম্মেল প্রমুখ।

তারা সব হারালেন : আক্তার কামাল সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির বেয়াই। সাবরাং আলীর ডেইল এলাকায় তার দোতলা বাড়িটি সম্প্রতি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আর ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন আক্তার কামাল নিয়েই। একইভাবে ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন সদর ইউনিয়নের নাজিরপাড়া এলাকার জিয়াউর রহমান। বাড়িটিও তার গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। একইভাবে জীবন ও সম্পদ হারিয়েছেন মোস্তাক আহমদ মুসু, হাসান আলী, সাবরাং নয়াপাড়ার সামশুল হক মার্কি ও নজির আহমদ। এভাবেই কয়েকমাস আগেও যারা ছিলেন সম্পদ ও ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের কারণে ক্ষমতাবান, মাত্র একরাতেই তাদের জীবন ধুলায় মিশে গেছে।

গতকাল পৌরসভা ও সদর ইউনিয়নের নাজিরপাড়া এলাকায় কয়েকটি ঘরে গিয়ে দেখা যায়, দুইতলা ও তিনতলা বাড়িগুলো ধ্বংসস্তুপ হয়ে পড়ে আছে। বাড়ির মালিক কিংবা তাদের স্ত্রী সন্তানরা ঘরে নেই। তার পরিবর্তে দূর সম্পর্কের আত্মীয় বাড়িটির দেখভাল করছেন। নিহত মোস্তাক আহমদ মুসুর ঘরেই কেবল পাওয়া গেল স্ত্রী রমিদা বেগম ও তিন শিশু সন্তানকে। রমিদা সন্তান সম্ভবা। এজন্যই ঘরে থাকেন বলে জানান। রমিদা বলেন, ছেলের বাবা ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার পর নিজের ১৭ বছরের মৃগী রোগী ছেলে ও একমাত্র দেবরকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি। তারা যাতে অন্তত বেঁচে থাকতে পারে।

হাসান আলীর ঘরে আছে তার দুর সম্পর্কের শ্যালক নুর মোহাম্মদ (২৫) ও তার এক মামাতো বোন। নুর মোহাম্মদ বলেন, দুলা ভাইয়ের মৃত্যুর পর আমার বোন ও বাচ্চারা অন্য জায়গায় চলে গেছে। এখন ঘরে আপাতত আমরাই আছি।

বাংলাদেশ সময়: ১০:৪৮:৩১   ৩১০ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

চট্টগ্রাম’র আরও খবর


ফিরলেন লিটন, নতুন মাইলফলক সাকিবের
চট্টগ্রামে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৩৩ হাজার ছাড়ালো
গুলির উৎস খুঁজতে গিয়ে মিলল অস্ত্রের কারখানা!
ফেনী শর্শদীর ইউপি চেয়ারম্যান সাময়িক বহিষ্কৃত
চট্টগ্রামের নির্বাচনেও মাঠে ছিল না বিএনপি - তথ্যমন্ত্রী
সহিংসতা-সংঘর্ষ-ইভিএম ভাঙচুর: ২ কেন্দ্রের ভোট স্থগিত
অপহরণের ৫ দিন পর মাদরাসাছাত্র উদ্ধার, আটক বাবুর্চি
চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর স্ত্রীর ওপর বিএনপির হামলা
মধ্যরাতে বন্যহাতির তাণ্ডব, প্রাণ গেল ২ কিশোরের
বিত্ত কখনো রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না - তথ্যমন্ত্রী

আর্কাইভ