চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্দর থানাধীন সল্টগোলাস্থ হারুন বিল্ডিং নামক স্থানের জনৈক হাফেজ আবদুস সালামের মেয়ে সাফিয়া আক্তার তানজি গত ২৬ জুন বেলা ১০টায় কোনো এক অজানা কারণে বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিরুদ্দেশ হয়। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় সে তার মা’কে বলে যায়, তাকে যেন খোঁজা না হয়। সে যেখানে যাচ্ছে সেখান থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব নয়। এর পর নিখোঁজ মেয়ের সন্ধান চেয়ে তানজির বাবা সিএমপির বন্দর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন (নম্বর ৩৯৬ তরিখ ০৮/০৭/২০১৯)।
এই জিডির সূত্র ধরেই র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর তার বিভিন্ন ইউনিটকে কাজে লাগায় এবং বিষয়টি আমলে নেয়। র্যাবের বিভিন্ন ইউনিটের পাশাপাশি র্যাব ২ উক্ত বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান অব্যাহত রাখে এবং জানতে পারে যে ওই মেয়েটিকে জঙ্গি সংগঠনের কে বা কারা নিয়ে গেছে। বিশেষ অভিযানে নামে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ২ এর একটি আভিযানিক চৌকস দল যার নেতৃত্ব দেন ক্রাইম প্রিভেনশন কম্পানি ৩ এর কম্পানি কমান্ডার পুলিশ সুপার মো. মহিউদ্দিন ফারুকী। দলটি শুরু করে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধান। র্যাব জানতে পারে, চট্টগ্রামেরই তার এক ‘সাথী বোনের’ সহায়তায় ফন্দি এঁটে জঙ্গিদলের সদস্যরা সাইফা আক্তার তানজিকে জিহাদে অংশ গ্রহণের উদ্দেশ্যে বের করে নিয়ে গেছে। জঙ্গি সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গিয়ে জানা যায়, সাইফা আক্তার তানজি চট্টগ্রামের লোহাগাড়া বা সাতকানিয়ার একটি কলেজে পড়ছিল। গত দুই বছর যাবৎ সে তার পিতা-মাতার সাথে চট্টগ্রাম শহরে থাকে। সেখানে থাকাকালে সে ফেসবুকসহ সোশাল মিডিয়ার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়লে জঙ্গি সংগঠনের ফেসবুক ও সোশাল মিডিয়ার সাথে তার সম্পৃক্ততা গড়ে ওঠে। আনসার আল ইসলাম নামের সংগঠনটি বর্তমানে নারী সদস্যদের তাদের দলে অন্তর্ভুক্ত করছে।
নিখোঁজ সাইফা আক্তার তানজির পরিবারের নিকট মেসেজ ও ফোনের সূত্র ধরে অনুসন্ধানকালে জানা যায়, তানজি গত ২৬ জুন বাসা থেকে বের হওয়ার পর সেখান থেকে তার সংগঠনের সাথী জান্নাতুল নাঈমার সাথে মিলিত হয়ে অজানায় রওনা হন। তানজি কার সঙ্গে কিভাবে, কখন, কোথায় গেল তার উৎস খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, বাসা থেকে বেরিয়ে নাঈমা নামের মেয়েটির সাথে দেখা করে। সেখান থেকে নাঈমা তার সংগঠনের নির্দেশে তানজিকে নিয়ে বরিশালের উদ্দেশ্যে রওনা হন।
তদন্তে জানা যায়, নাঈমা ও তার সংগঠনের সদস্যরা ফেসবুকে একটি গ্রুপে যুক্ত থেকে সংগঠনের কর্মী সংগ্রহে লিপ্ত। জিহাদি মনোভাবসম্পন্ন পুরুষ ও নারী সদস্যদের দলভুক্ত করে আনসার আল ইসলামের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন তাদের মূল উদ্দেশ্য। জানা যায়, বরিশালের কোনো এক ব্যক্তি আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার প্রলোভন বা বিয়ের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে তানজিকে ঘর থেকে বের করেছেন। বরিশাল শহরের একটি হাই স্কুলে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করা এক ব্যক্তি আনসার আল ইসলামের নেতৃস্থানীয় সদস্য। বরিশালে কোথায় কিভাবে নিয়েছে- সে বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমে জানা যায়- তানজি ও নাঈমা গত ২৬ জুন রাত ৯টায় বরিশাল শহরের একট বাসস্ট্যান্ডে বাস থেকে নামেন। সেখানে পূর্ব থেকে অপেক্ষমাণ আনসার আল ইসলামের স্থানীয় সংগঠক সাইফ পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী শহরের এতকটি মাদরাসায় তানজিকে ভর্তি করান। সেখানে নাঈমা নামের মেয়েটি তানজিকে জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রমের জন্য প্রস্তুত করার লক্ষ্যে নিজেও ছাত্রী হিসেবে তানজির সাথে স্থানীয় একটি মাদরাসায় ভর্তি হন। সেখানে ভর্তি ফিসহ মাদরাসায় থাকা-খাওয়ার টাকা সাইফ নামের ব্যক্তি পূর্বেই পরিশোধ করে দেন। সাইফ ও তার সংগঠনের নারী সদস্যদের উদ্দেশ্য হলো তানজিকে মাদরাসায় রেখে তার পরিবারপ্রীতি কমানো এবং সময় অনুযায়ী আত্মঘাতী যেকোনো জঙ্গি কার্যক্রমে নিয়োগ করা। এ ক্ষেত্রে সাইফ কর্তৃক বিয়ের প্রলোভন দেখানো, নাঈমা ও তার অপর সদস্যদের প্ররোচনায় তানজিকে সাইফের নিকট বিবাহ দেওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।
র্যাব ২ এর আভিযানিক দল বরিশাল শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি আবাসিক মহিলা মাদরাসা থেকে তানজি নামের ভিকটিমকে গত ৯ জুলাই রাত সাড়ে ১২টায় উদ্ধার করে। উদ্ধারকৃত তানজিকে জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায়, তার ফেসবুক বন্ধু নাঈমা ও অন্যান্য সাথীদের প্ররোচনায় সে সাইফ নামের ব্যক্তিকে বিবাহ করে স্বামীর চাহিদা অনুযায়ী জিহাদে শামিল হবে। তানজি জানায়, সাইফ উগ্র জিহাদি মনোভাবসম্পন্ন ব্যক্তি। ফেসবুকে বা ফোনে যখনই তার সাথে কথা হতো, সাইফ প্রকারান্তরে তানজিকে জিহাদে শামিল হওয়া, একই সাথে শাহাদাতের মৃত্যু কামনা করা, শহীদের রাস্তায় মৃত্যু কামনা করা সহ সর্বাবস্থায় তাকে জিহাদে শামিল বা কালো পতাকার নিচে শামিল হওয়ার আহ্বান জানাত। তানজি আরো জানায়, মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার সময় তানজি সাইফের কথানুযায়ী তানজি ও তার ‘সাথী বোন’ নাঈমা একই পিতার কন্যা পরিচয় দিয়ে ভর্তি সম্পন্ন করে।
পরবর্তীতে তানজির দেখানো মতে জঙ্গিবাদে উদ্ভুদ্ধ করা ও জঙ্গি সংগঠনে শামিল করানোর অপরাধে আনসার আল ইসলামের নারী সদস্য নাঈমাক বরিশাল শহরের রুপাতলী মাদরাসা থেকে আটক করা হয়। ধৃত নাঈমা জানায়, তার সহযোগী ভাইদের প্ররোচনায় সে নিজে, সাঈফ, আফজাল, মীর ইব্রাহিম, সাইফুল, আবু সালেহ, হেমায়েত, নিগারসহ অনেকেই এই ঘটনার সাথে জড়িত। ধৃত নাঈমার বক্তব্য অনুযায়ী রাজধানীর ডেমরা থেকে উক্ত সংগঠনের সদস্য আফজালকে ৯ জুলাই মকাল ১০টায় গ্রেপ্তার করা হয়।
ধৃত আসামিরা এ কাজের মাধ্যমে ধর্মভীরু, সহজ-সরল ও শান্তিপ্রিয় মেয়েদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও নাশকতা সৃষ্টি ও জিহাদে উদ্বুদ্ধ করে আত্মঘাতী হামলা চালানোর জন্য উসকানি করে আসছিল।
আটককৃতদের বিরুদ্ধে সিএমপি বন্দর থানায় আইনি কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। দলের অন্যান্য সদস্যদের ধরতে র্যাবের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ সময়: ২২:১৩:৩৫ ১৩৪ বার পঠিত