আজ শুক্রবার রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের জোৎস্নার স্নিগ্ধ আলোয় ৫৫ বছর পথচলা পূর্ণ হলো।
৫৫ বছর আগে তিনি কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার জাফরাবাদ গ্রামের ইতিহ্যবাহী বনেদি পরিবার খান বাড়ির রাশেদা খানম জোৎস্নার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সুদীর্ঘ গৌরবোজ্জ্বল রাজনৈতিক জীবনের আন্দোলন সংগ্রাম, উত্থান- পতন, হামলা মামলা, পুলিশি হয়রানি-নির্যাতন, কারাবাস,মহান মুক্তিযুদ্ধের টালমাটাল উত্তাল দিন এবং রণাঙ্গনের অনুপ্রেরণা ছিলেন তার সহধর্মিণী রাশেদা খানম জোৎস্না।
এ বিদূষী নারীর পরম মমতা, অকৃত্রিম ভালোবাসা আর অনুপ্রেরণার পাখায় ভর করেই রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ আজ সৌভাগ্যের শীর্ষবিন্দু দর্শন করেছেন। রাষ্ট্রপতি হিসাবে একমাত্র তিনিই রেকর্ড পরিমাণ সময় ধরে তার প্রেরণার উৎস সহধর্মিণী জোৎস্নাকে নিয়ে ঠাঁই পেয়েছেন বঙ্গভবনে।
তাদের বর্ণাঢ্য দাম্পত্য জীবনের স্বপ্নঘড়ি হচ্ছেন চার কৃতী সন্তান একাধারে তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত বর্তমান সংসদের কনিষ্ঠ সদস্য রেজওয়ান আহমেদ তৌফিক এমপি, বিশিষ্ট সমাজকর্মী ও রাজনৈতিক রাসেল আহমেদ তুহিন, কৃষিবিদ রিয়াদ আহমেদ তুষার ও আইনজীবী কন্যা স্বর্ণা হামিদ।
এ গর্বিত দম্পত্তির চাঁদের হাটে এখন যোগ দিয়েছেন নাতি-নাতনিও।
মো. আবদুল হামিদ ১৯৪৪ সালের পয়লা জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন উপজেলার কামালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মরহুম হাজী মো. তায়েব উদ্দিন এবং মাতার নাম মরহুমা তমিজা খাতুন।
মো. আবদুল হামিদ কিশোরগঞ্জ নিকলী জিসি হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ থেকে আইএ ও বিএ ডিগ্রি এবং ঢাকার সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষাজীবন সমাপ্তির পর তিনি আইন পেশায় নিয়োজিত হন।
মো. আবদুল হামিদের রাজনৈতিক জীবনের শুরু হয় ১৯৫৯ সালে তৎকালীন ছাত্রলীগে যোগদানের মাধ্যমে। ১৯৬১ সালে কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৬২ সালে ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেয়ার কারণে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাকে কারারুদ্ধ করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৬৪ সালে কিশোরগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ১৯৬৫ সালে কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সহসভাপতি এবং ১৯৬৬-৬৭ সালে ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি নির্বাচিত হন।
ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানের কারণে ১৯৬৮ সালে তিনি কারাবরণ করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।
মো. আবদুল হামিদ ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ৭১-এর মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে তিনি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কিশোরগঞ্জে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৭ মার্চ কিশোরগঞ্জ শহরের রথখোলা মাঠে ছাত্র জনসভায় হাজার হাজার লোকের উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করেন।
২৬ মার্চের প্রথমপ্রহরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ঐদিন সকালেই স্বাধীনতার ঘোষণা টেলিগ্রামের মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়ে সর্বাত্মক মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ব্যয় নির্বাহের জন্য তিনি বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় এপ্রিলের প্রথম দিকে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের কিশোরগঞ্জ, ভৈরব ও বাজিতপুর শাখা থেকে আনুমানিক ১১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা সংগ্রহ করে ওই সময় নিরাপদ স্থান হিসেবে বিবেচিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া ন্যাশনাল ব্যাংক শাখায় জমা রাখেন।
এরপর তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতের আগরতলায় চলে যান। তখন বৃহত্তর চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লার অধিকাংশ সংসদ সদস্য সেখানে অবস্থান করছিলেন। আবদুল হামিদ মুক্তিযুদ্ধের কৌশলগত বিভিন্ন দিক নিয়ে তাদের সাথে আলোচনা ও শলা-পরামর্শ করেন।
একইসঙ্গে তিনি আগরতলায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। পরে তিনি এপ্রিলের শেষ দিকে বাংলাদেশে এসে আরও কিছু সহযোগীসহ আবার মেঘালয়ের টেকেরহাট, গুমাঘাট, পানছড়া, মৈইলাম হয়ে বালাহাট পৌঁছান।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশ থেকে আগতদের জন্য তিনি ইয়ুথ রিসিপশন ক্যাম্প চালু করেন এবং এর চেয়ারম্যান ছিলেন।
মূলত কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আগতদের প্রাথমিক বাছাই কাজ এখানে করা হতো। এ ছাড়া মেঘালয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে গঠিত জোনাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিলের তিনি অন্যতম সদস্য ছিলেন।
আবদুল হামিদ ভারতের মেঘালয়ে রিক্রুটিং ক্যাম্পের চেয়ারম্যান হিসেবে তৎকালীন সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলার বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (মুজিব বাহিনী) সাবসেক্টর কমাণ্ডার পদসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় তিনি এ দায়িত্বে ছিলেন।
১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে তিনি মেঘালয়ে অবস্থানকারী শরণার্থীদের দেশে প্রত্যাবর্তনে উদ্বুদ্ধ করতে বিভিন্ন ক্যাম্পে সভা করেন। শরণার্থীদের দেশে ফেরা নিশ্চিত করার পর তিনি ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে আসেন।
স্বাধীনতার পর তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৭৪ সালে তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নির্বাচিত হন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৭৬-৭৮ সালে তৎকালীন সরকারের সময় তিনি কারারুদ্ধ হন। তিনি ১৯৭৮ সাল থেকে ২০০৯ সালের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ১৯৯০ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত পাঁচবার কিশোরগঞ্জ বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির দায়িত্বপালন করেন।
একজন সমাজসেবক ও শিক্ষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক মো. আবদুল হামিদ মিঠামইন তমিজা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, মিঠামইন বালক উচ্চ বিদ্যালয়, মিঠামইন কলেজসহ এলাকায় প্রায় ৩০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২৪টি উচ্চ বিদ্যালয় ও ৩টি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন।
তিনি অষ্টগ্রাম কলেজ, মিঠামইন ডিগ্রি কলেজ, ইটনা ডিগ্রি কলেজ, মিঠামইন হাইস্কুল, তমিজা খাতুন গার্লস হাইস্কুল, এলংজুড়ি হাইস্কুল, ইটনা গার্লস হাইস্কুল, বারিবাড়ি হাইস্কুল, আবদুল্লহপুর হাইস্কুল, আবদুল ওয়াদুদ হাইস্কুল, কিশোরগঞ্জ গার্লস হাইস্কুল, ধনপুর হাইস্কুল, শহীদ স্মৃতি হাইস্কুল, মোহনতলা হাইস্কুল এবং ঘাগড়া আ. গণি উচ্চ বিদ্যালয়ের পৃষ্ঠপোষকসহ তার নির্বাচনী এলাকার আরও অনেক জুনিয়র হাইস্কুল ও মাদ্রাসার পৃষ্ঠপোষক।
মো. আবদুল হামিদ সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট কমিটি, ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (আইপিইউ), কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের (সিপিএ) কমিটি এবং খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্বপালন করেন।
তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি, কিশোরগঞ্জ জেলা পাবলিক লাইব্রেরির আজীবন সদস্য ও নির্বাহী সদস্য। কিশোরগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সম্মান সূচক সদস্য, জেলা শিল্পকলা একাডেমি, কিশোরগঞ্জ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এবং কিশোরগঞ্জ রাইফেলস ক্লাবের আজীবন সদস্য।
তিনি ১৯৭০ সালে ময়মনসিংহ-১৮ সংসদ নির্বাচনী এলাকা থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য, ১৯৭২ সালে গণপরিষদ সদস্য, ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-৫ আসন থেকে, ১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সাতবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
মো. আবদুল হামিদ সপ্তম জাতীয় সংসদে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন এবং ১৩ জুলাই ১৯৯৬ থেকে ১০ জুলাই ২০০১ পর্যন্ত এ পদে দায়িত্বপালন করেন। পরবর্তীতে তিনি স্পিকার নির্বাচিত হন এবং ১২ জুলাই ২০০১ থেকে ২৮ অক্টোবর ২০০১ পর্যন্ত দায়িত্বপালন করেন।
অষ্টম জাতীয় সংসদে তিনি ২০০১ সালের নভেম্বর থেকে বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে দায়িত্বপালন করেন।
তিনি ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
নবম জাতীয় সংসদে তিনি স্পিকার নির্বাচিত হন এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সফলভাবে এ দায়িত্বপালন করেন। নবম জাতীয় সংসদে তিনি কার্য উপদেষ্টা কমিটি, কার্যপ্রণালী-বিধি সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি, বিশেষ অধিকার সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি এবং পিটিশন কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্বপালন করেন।
সরকারি সফর, সেমিনার, সভা ও ব্যক্তিগত কাজে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, কানাডা, ভারত, জিব্রালটার, বার্বাডোজ, মিশর, সিঙ্গাপুর, দুবাই, আবুধাবী, থাইল্যান্ড, মরক্কো, সৌদি আরব, সাউথ আফ্রিকা, নামিবিয়া, সুইজারল্যান্ড, হংকং, কুয়েত, ইরান, কোরিয়া, মঙ্গোলিয়া, চায়না, সুইডেন, ফিজি, অস্ট্রেলিয়া, কিরিবাতি, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, জাপান, নাউরো প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মো. আবদুল হামিদকে স্বাধীনতা পুরস্কার ২০১৩ এর হিরণ্ময় পালকে ভূষিত করা হয়।
প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন থাকাকালে ২০১৩ সালের ১৪ মার্চ থেকে তিনি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্বপালন করেন। ওই বছরের ২০ মার্চ মো. জিল্লুর রহমান মৃত্যুবরণ করলে সেদিন থেকে তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্বপালন করেন।
ওই বছরের ২২ এপ্রিল তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতেও রাষ্ট্রপতির গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয় তার ওপর।
বাংলাদেশ সময়: ২৩:৩২:৫২ ২৫৫ বার পঠিত