দেশে এখন যেকোনো পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের আগাম দুশ্চিন্তা ঘিরে থাকে পরীক্ষার্থী তাদের অভিভাবকের মাঝে। এমনকি সরকার ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোরও প্রধান উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রশ্নফাঁস। তবে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে চলমান এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোনো অভিযোগ ওঠেনি এখনো। কিন্তু এর মধ্যেই রাজশাহীতে সক্রিয় ভুয়া প্রশ্ন সরবরাহ চক্র।
ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে চক্রটি প্রশ্ন ফাঁসের নামে পরীক্ষার্থী ও তার স্বজনদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার টাকা। আর তা লেনদেন হচ্ছে বিকাশের মাধ্যমে। ফলে ভুয়া প্রশ্ন সরবরাহকারীকে চিনতে পারছে না পরীক্ষার্থীরা। অবশ্য তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে এদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
গত ৪ এপ্রিল রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার সাইধাড়া গ্রাম থেকে প্রথমে রবিউল ইসলাম ওরফে জনি (১৮) নামের একজন ভুয়া প্রশ্ন ফাঁসকারী চক্রের সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এরপর তাকে র্যাব-৫ এর কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সেখানে সে প্রশ্ন ফাঁস করা চক্রের অন্তত ২৫ জনের নাম জানায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের বাড়ি। এদের কাছ থেকে ‘প্রশ্নপত্র’ আসত জনির কাছে। তারপর রাজশাহী অঞ্চলের পরীক্ষার্থীদের কাছে তা সরবরাহ করত জনি।
জিজ্ঞাসাবাদে র্যাবকে জনি জানায়, দীর্ঘদিন ধরে এ কাজ করে আসছিল সে। কখনো আসল, কখনো নকল প্রশ্ন দিয়ে সে টাকা নিয়েছে। গেল এসএসসি ও জেএসসি পরীক্ষায় সে অনেক পরীক্ষার্থী ও তার স্বজনদের কাছে প্রশ্ন সরবরাহ করেছে। এ জন্য টাকা নেওয়া হয়েছে বিকাশের মাধ্যমে। গ্রেপ্তারের আগে চলতি এইচএসসি পরীক্ষাতেও সে অন্তত পাঁচজনকে প্রশ্ন দিয়েছে। তবে সেগুলো ভুয়া।
র্যাব কর্মকর্তারা ওই দিন জনির মুঠোফোনের দুটি সিমে বিকাশের মাধ্যমে অস্বাভাবিক অর্থ লেনদেনের প্রমাণ পান। র্যাব-৫ এর উপ-অধিনায়ক মেজর এ এম আশরাফুল ইসলাম জানান, জনির দেওয়া ২৫ জনের নাম র্যাব হেডকোয়াটার্সকে তারা জানিয়ে দেন। এর পরই শুরু হয় গ্রেপ্তার অভিযান। র্যাব-৫ এর আওতায় থাকা রাজশাহী অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকেও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এর মধ্যে ৫ এপ্রিল নওগাঁর আত্রাইয়ের জয়সারা এলাকা থেকে ফয়সাল হোসেন নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়। তার কাছ থেকে জব্দ করা হয় একটি ল্যাপটপ, একটি মোবাইল ফোন, সাতটি সিমকার্ড, পাঁচটি মেমোরি কার্ড, একটি মডেম, একটি পেনড্রাইভ ও কার্ড রিডার।
৮ এপ্রিল রাজশাহীর তানোর উপজেলার মানিককন্যা গ্রাম থেকে মুস্তাফিজুর রহমান ওরফে মুক্তা নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়।
এ ছাড়া গত রবি ও সোমবার গ্রেপ্তার করা হয় রাজশাহীর চারঘাট, নওগাঁর মান্দা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলা থেকে তিন তরুণকে। তারা হলো- চারঘাট উপজেলার রাওথা গ্রামের রনি সরকার, মান্দা উপজেলার তেতুলিয়া শেখপাড়া গ্রামের মুরাদ শেখ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার বড় জামবাড়িয়া গ্রামের নুরুজ্জামান ওরফে নিশান।
রনির কাছ থেকে তিনটি মোবাইল ফোন, ১৪টি সিমকার্ড, একটি মেমোরি কার্ড, দুটি কার্ড রিডার, একটি সিপিইউ, একটি মনিটর ও প্রশ্নপত্র বিক্রির নগদ ১০ হাজার ৫০০ টাকা জব্দ করা হয়। ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন ও মেমোরি কার্ড জব্দ করা হয় মুরাদের কাছ থেকে। আর নিশানের কাছ থেকে জব্দ করা হয় তিনটি মোবাইল ফোন সেট, ২৬টি সিমকার্ড ও দুটি মেমোরি কার্ড।
র্যাব কর্মকর্তা আশরাফুল আলম জানান, আটক ব্যক্তিরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইমো ও হোয়াটস অ্যাপের মাধ্যমে প্রশ্ন সংগ্রহ ও সরবরাহ করত। এবার প্রশ্ন ফাঁস না হওয়ায় তারা নকল প্রশ্নপত্র ছাপিয়ে পরীক্ষার্থীদের কাছে সরবরাহ করত। এভাবে ভুয়া প্রশ্নের জমজমাট ব্যবসা করে যাচ্ছিল তারা। এই চক্রের অনেকেই আবার ‘১০০ ভাগ কমন সাজেশনের’ নামেও প্রশ্নগুলো শিক্ষার্থীদের কাছে সরবরাহ করছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই চক্রের কেউ কেউ পরীক্ষা শুরুর আগের দিন ভুয়া প্রশ্ন ঝাপসা করে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়। এভাবে তারা পরীক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই প্রচারণা সারা দিন চলতে থাকে। পরীক্ষার আগের রাতে অন্য একটি ভুয়া প্রশ্নপত্রের আরেকটু পরিষ্কার ছবি ফেসবুকে প্রকাশ করা হয়।
এরপর পরীক্ষার দিন ভোর পাঁচটা থেকে সকাল সাড়ে আটটা পর্যন্ত অন্য একটি প্রশ্নপত্রের সম্পূর্ণ কপি প্রকাশ করা হয়। এই প্রশ্নটি দেখতে আসল প্রশ্নপত্রের মতো।
এই প্রশ্নপত্রের ওপরে সালের জায়গায় শুধু ২০১৮ লেখা হয়। আবার কখনো কোনো টেস্ট পেপারে উদাহরণ হিসেবে থাকা প্রশ্নের ছবি তুলে সেটাও আসল প্রশ্ন হিসেবে ফেসবুকে প্রচার করা হয়। আর এসব ভুয়া প্রশ্ন পোস্ট করা হতো ছদ্মনামে খোলা আইডি দিয়ে। শিক্ষার্থী বা অভিভাবকরা ওই প্রশ্ন পেতে চাইলে ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে এই চক্রের সদস্যদের সঙ্গে কথা শুরু করেন।
প্রশ্ন সরবরাহ ও টাকা লেনদেনের প্রক্রিয়া
চক্রের সদস্যরা প্রশ্নের জন্য তাদের বিকাশ অ্যাকাউন্ট নম্বর দিয়ে তাতে আগাম টাকা পাঠাতে বলে। শর্তে রাজি হয়ে বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠালে তাৎক্ষণিকভাবে তাকে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে এক কপি ভুয়া প্রশ্ন পাঠানো হয়। পরীক্ষায় আসা প্রশ্নের সঙ্গে না মিললে ক্রেতাকে জানানো হয়, সেটটি বাতিল হয়েছে। আর এভাবেই প্রতারণার মাধ্যমে চক্রের সদস্যরা হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার টাকা।
ভুক্তভোগী একজন পরীক্ষার্থীর স্বজন জানান, তিনি এক হাজার টাকার বিনিময়ে এইচএসসির ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্ন নিয়েছিলেন। ফেসবুকে একটি পোস্ট দেখে তিনি ম্যাসেজের মাধ্যমে চক্রের সদস্যর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বিকালে প্রশ্নটি নেওয়ার পর রাতেই তাকে আবার জানানো হয়, সেট পরিবর্তন হয়েছে। নতুন সেটের প্রশ্ন নিতে আরও এক হাজার টাকা দিতে হবে। তিনি আবার প্রশ্ন নেন। কিন্তু পরীক্ষার পর দেখেন, দুটি প্রশ্নপত্রই ভুয়া।
জানা গেছে, যেসব ফেসবুক আইডি ও পেজ থেকে প্রশ্নের প্রলোভন দেখিয়ে পোস্ট দেয়া হয়, সেগুলো ছদ্মবেশে নজরদারি করছেন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা।
এর আগে ২০১৬ সালের অক্টোবরে মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার ভুয়া প্রশ্ন ছড়ানোর অভিযোগে রাজশাহী মহানগরী থেকে একটি কোচিং সেন্টারের মালিকসহ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাদের সঙ্গে নতুন প্রশ্ন ফাঁসকারীদের কোনো যোগসূত্র আছে কি না তা খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা।
র্যাব-৫ এর মেজর এ এম আশরাফুল ইসলাম জানান, ভুয়া প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা করা হচ্ছে। তারা প্রতারণা করলেও তা ইন্টারনেটভিত্তিক হওয়ায় মামলা করা হচ্ছে এ আইনে। এর ভেতরেই তাদের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ থাকছে। সহজে তাদের জামিন মিলবে না বলেই মনে করছেন র্যাবের এই কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ সময়: ১৫:২২:৩১ ২৫০ বার পঠিত