সড়কে মামলা থেকে বাঁচতে পুলিশের কাছে যার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব বা পিএস পরিচয় দেয়ার অভিযোগ উঠেছে, তিনি সরকার প্রধানের কার্যালয়ের কেউ না। তিনি একজন উপসচিব। শ্রম প্রতিমন্ত্রী মজিবুল হক চুন্নুর একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করেন তিনি।
তার নাম অমর চান বণিক। সম্প্রতি একজন পুলিশ কর্মকর্তা সড়কে অবৈধ পার্কিং এর অভিযোগে মামলা করতে চাইলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর নাম বেচার চেষ্টা করেন বলে ওই পুলিশ কর্মকর্তা ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করে জানিয়েছেন।
তবে এই উপসচিবের দাবি, তিনি প্রধানমন্ত্রীর পিএস পরিচয় দেননি। তিনি শ্রম প্রতিমন্ত্রীর পিএস পরিচয়ই দিয়েছেন। যদিও ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর পিএস পরিচয় তিনি একাধিকবার দিয়েছেন।
সম্প্রতি ঘটনাটির ভিডিও দিয়ে পুলিশ পরিদর্শক তারিকুল ইসলাম সুমন একটি স্ট্যাটাস দেয়ার পর কদিন ধরেই সামাজিক মাধ্যমে চলছে তোলপাড়। ওই ফেসবুক স্ট্যাটাসের সূত্র ধরেই সংবাদও প্রকাশ হয়েছে অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে। তবে সেখানে ওমর ফারুক বণিকের নাম বা পরিচয় আসেনি।
এক সপ্তাহ আগে গত ১৫ এপ্রিল রাজধানীর ভিকারুননিসা গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে অবৈধ গাড়ি পার্কিং করে রাস্তায় যানজট সৃষ্টি করেছিলেন বেশ কয়েকজন অভিভাবক। ডিএমপির ট্রাফিক দক্ষিণের পরিদর্শক তারিকুল ইসলাম সুমন নিজে সেখানে গিয়ে নয়টি গাড়ির কাগজ নিয়ে মামলা দেন।
কিন্তু একজন গাড়ির মালিক কাগজ দিতে ও মামলা নিতে রাজি হচ্ছিলেন না। এসময় পুলিশের সঙ্গে বাঁধে বিপত্তি।
এক পর্যায়ে ওই ব্যক্তি নিজেকে নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর পিএস পরিচয় দিয়ে কেবল গাড়িটি ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু পুলিশ পরিদর্শক তারিকুল ইসলাম সুমন নাছোড়বান্দা। তিনি মামলা দিয়ে তারপর গাড়ি ছাড়বেন বলে সাফ জানিয়ে দেন। তখন পুরো ঘটনাটির ভিডিও করা হয় আর সেই ভিডিও তারিকুল তার ফেসবুক পেজে ছাড়লে সেটা ভাইরাল হয়ে।
ঘটনার যে বর্ণনা দিলেন পুলিশ কর্মকর্কতা
জনাব বণিকের সঙ্গে বাদানুবাদের কাহিনি উল্লেখ করে তরিকুল লেখেন, ‘উনি নিজেকে পিএম এর পিএস বলে পরিচয় দিচ্ছেন, যদিও আমি তা যাচাই করে দেখিনি। উনি মামলা তো দূরের কথা,গাড়ির কাগজই দেবেন না,আমি যা পারলে করি।’
‘আমি উনাকে বারবার স্যার সম্বোধন করে বলি যে, উনাকে আমি ছাড়লে সবাইকে ছাড়তে হবে,নইলে বাকি নয়জনের কাছে পরকালে হলেও জবাবদিহি করতে হবে। তাই উনাকে ছেড়ে দিয়ে সেই পাপের দায়ভার নিতে পারব না। উনি আমার উপর দিয়েই গাড়ি চালিয়ে যাবেন এই অবস্থা।’
‘আমিও নাছোড়বান্দা, বললাম আমার লাশ পড়লেও আপনাকে মামলা নিয়ে যেতে হবে। উনি খুব গরম দেখাচ্ছিলেন, তাই আমি পথচারীকে ভিডিও করতে বলি, উনার গরম তখন পালাল। আমি নয়শ টাকা জরিমানা করলাম।’
‘উনি আমার নাম জানতে চাইলে আমি এক ডিগ্রি এগিয়ে নিজের ভিজিটিং কার্ড দিয়ে সালাম দিয়ে বললাম, “Sir, you can transfer me anywhere of Bangladesh.’
পুলিশ কর্মকর্তা লেখেন, ‘আমি রাস্তার কামলা, কামলাই থেকে যাব, বেতন এক টাকাও কমবে না, আপনি যদি ভদ্রভাবে পরিচয় দিয়ে বলতেন, আমি পিএম এর পিএস, আজকের মত আমাদের সবাইকে ছেড়ে দেন, আর কোনদিন এভাবে গাড়ি রাখব না, আমি আপনাকে সহ সবাইকে সসন্মানে ছেড়ে দিতাম। কিন্তু আপনি ক্ষমতা দেখিয়ে শুধু আপনারটাই ছাড়াতে চাচ্ছেন, অন্য কারোটা নয়, অথচ আপনারা সবাই একই অপরাধে অপরাধী।’
সরকারি উচ্চপদস্থ চাকুরের ‘গরম’ দেখে ঢাকার বাইরে বদলি হওয়ার আশঙ্কা করছেন পুলিশ কর্মকর্তা তরিকুল। তবে পরোয়া করেন না তিনি।
একটি সুন্দর সমাজের স্বপ্ন দেখা তরিকুলের ভাবনাটা এমন, ‘আমি অমুক, আমি তমুক,এই পরিচয়ে এক্সট্রা প্রিভিলেজ পাওয়ার চিন্তাটা আমরা বাদ দেব কবে? কেন অপরাধ করে তার পানিশমেন্টটা আমরা নিতে চাই না?’
‘প্রধানমন্ত্রীর পিএস পরিচয় দিইনি’
ওই দিনের ঘটনার বিষয়ে উপসচিব অমর চান বণিক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সেদিন আমার কোনো ফল্ট (দোষ) ছিল না। আমি রাস্তা বন্ধ করে রাস্তায় কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিনি। বাচ্চাকে স্কুল থেকে (ভিকারুননিসা গার্লস স্কুল) নিয়ে গাড়িতে ওঠার পরই ওই ট্রাফিকের পুলিশের টিআই আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেন।’
কিন্তু আপনি ট্রাফিক আইনে মামলা থেকে বাঁচতে প্রধানমন্ত্রীর পিএসের পরিচয় দেবেন কেন?-এমন প্রশ্নে ওমর চান বণিক দাবি করেন, তিনি এই পরিচয় দেননি।
উপসচিব বলেন, ‘আমি সেদিন বলেছিলাম, আমি শ্রম প্রতিমন্ত্রীর পিএস। এসময় ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আপনি মন্ত্রীর পিএস হন বা পিএম এর পিএস হন তাতে আমার কিছু আসে যায় না।’
‘এখন ওই জায়গা টুকু নিয়ে লাগছে। আমি পিএম-এর পিএস পরিচয় দিয়েছি? আমি কি পাগল হয়েছি যে আমি পিএম-এর পিএস পরিচয় দেব নিজেকে? এইগুলো ঠিক না।’
ওই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবেন?-এমন প্রশ্নে ওমর চান বণিক বলেন, ‘না, আমি কী ব্যবস্থা নেব?’
-‘ওই দিন আপনার পার্কিং অবৈধ ছিল?’
‘ওই দিন কোন পার্কিং অবৈধ ছিল না। সিঙ্গেল লাইন ছিল, কোন যানজট ছিল না। আমি স্কুল থেকে বাচ্চাকে বের করে গাড়িতে তুলব কীভাবে; গাড়ি কি আকাশে রাখব? এখন বলা হচ্ছে, আমি আমি রাস্তায় গাড়ি রেখে যানজটের সৃষ্টি করেছি।’
- ‘আপনি ওই দিন অবৈধ পার্কিংয়ের জন্য জরিমানার টাকা দিতে চেয়েছিলেন কেন?’
-‘জরিমানা আমি দেব কেন? অপরাধ করছে ড্রাইভার, সে দেবে। আমার নামে কি মামলা হয়েছে? তার (ড্রাইভার) নামে মামলা হয়েছে, সে দিতে চেয়েছে। আপনারা ভুল বোঝাবুঝি করেন কেন?’
-‘পুলিশের ওই কর্মকর্তাকে কি অতি উৎসাহী ছিল?
-‘হুঁ’।
‘অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর পিএস পরিচয় দিয়েছেন’
অমর ফারুক বণিক নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর পিএস পরিচয় দেয়ার কথা অস্বীকার করার বিষয়ে আবার যোগাযোগ করলে পুলিশ কর্মকর্তা তরিকুল তার বক্তব্যে অটল থাকার কথা জানান।
তরিকুল বলেন, ‘অবশ্যই তিনি প্রধানমন্ত্রীর পিএস পরিচয় দিয়েছেন। যখন ভিডিও করা হয়, তখন আমি তাকে বলেছি, আপনি প্রধানমন্ত্রীর পিএস, আপনি সম্মানীয় লোক, আপনি গাড়ির কাগজ দেন। বারবার তাকে প্রধানমন্ত্রীর পিএস হিসেবে সম্মান দিয়ে আসলেও এখন কেন তিনি বলছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীর পিএস না?’
এদিকে বিআরটিএ থেকে জানা যায়, যে গাড়িটির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, সেটির মালিক ওমর চান বণিক নিজেই। এর ফিটনেসের মেয়াদ ২০১৫ সলের ২৮ এপ্রি শেষ হয়েছে। কিন্তু গত তিন বছরেও সেটি নবায়ন হয়নি।
বাংলাদেশ সময়: ১২:১৪:২১ ২৯১ বার পঠিত