আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা/ নবীন ধানের মঞ্জুরি দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা/ এসো গো শারদলক্ষ্মী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে/ এসো নির্মল নীলপথে…। এসেছে শরৎ। নির্মল নীলাকাশ, গুচ্ছ গুচ্ছ শুভ্র অমল ধবল মেঘের ভেলা; দূরে দুধেল সাদা কাশের বনে পাগলা হাওয়ার মাতামাতি নিয়ে। আজ ১ ভাদ্র।
‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা/ নীলাকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই লুকোচুরি খেলা’— পঙক্তিতে কবিগুরু শরেক ‘স্বল্পায়ু’ বলেছেন। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে প্রতিটি ঋতুই ভিন্ন ভিন্ন রূপবৈচিত্র নিয়ে সমুখে দাঁড়ায়। নতুন করে সাজে প্রকৃতি। গ্রামে যেমন, শহরেও তাই। এখন গ্রামের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে নবীন ধানের সাথে কাশফুলের দোলা আর শহরের নীল আকাশে ভেসে বেড়ায় সাদা মেঘের ভেলা।
অনুপম রূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত শরতের মমতামাখা নাম ‘শারদ লক্ষ্মী’। বর্ষাবিধৌত, মেঘমুক্ত আকাশের সুনীল রূপ-কান্তি, লঘুভার মেঘের অলস-মন্থর নিরুদ্দেশ যাত্রা, আলোছায়ার লুকোচুরি, শিউলি ফুলের মন উদাস করা গন্ধ, ঊষার তৃণপল্লবে নব শিশিরের আল্পনা, তাতে প্রভাত-সূর্যের রশ্মিপাত ও শুভ্র জোছনা পুলকিত রাত্রি— এ অনুপম রূপ নিয়ে বাংলার বুকে ঘটে শারদ লক্ষ্মীর আনন্দময় আবির্ভাব।
গতকাল আকাশে রোদ্র-মেঘের লুকোচুরি জানান দিয়েছে তার আগমনীবার্তা। আজ প্রকৃতির মালিন্য মুছে দিতে মেঘের সিংহবাহনে এলো সে ‘মধুর মুরতি’ নিয়ে। শরৎ চেনা যায় প্রকৃতির মাঝে তার স্বল্প আয়োজনের জন্য। শরতের সম্ভার ওই শিশিরাশ্রু শেফালিকা, কাশমেঘ; আর আগমনী উৎসবে তার সমাপ্তি। শরৎ হচ্ছে আকাশ ও মাটির মিলন। একদিকে নীলাকাশ, আরেকদিকে কচি ফসলের দুরন্তপনা; একদিকে সোনা রোদ, আরেকদিকে সবুজের কচিমুখ; সঙ্গে আকাশ ও মৃত্তিকার যে হৃদয়াবেগ, তা আমাদের হৃদয়কে নাড়া দিয়ে যায়। ভাদ্র মনকে উদ্বেলিত করে। প্রকৃতির সবুজ ছড়িয়ে পড়ে মাঠে-ঘাটে। এ স্নিগ্ধরূপ তারুণ্যকে উচ্ছ্বসিত আনন্দে ভাসার উদ্বেগ সৃষ্টি করে। প্রকৃতি তার ভালোবাসা দিয়ে আপন করে নিতে চায় সকল মনকে। শরৎ সেই ভালোবাসার মনে দোলা দিয়ে যায়। তাই মহাকবি কালিদাস শরতের বন্দনা করেছেন: ‘প্রিয়তম আমার! ঐ চেয়ে দেখো, নববধূর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎকাল সমাগত।’
শরৎকালে কখনো কখনো বর্ষণ হয়, তবে বর্ষার মতো অবিরাম নয়। বরং শরতের বৃষ্টি মনে আনন্দের বার্তা বয়ে আনে। চারপাশের শুভ্রতার মাঝে বৃষ্টির ফোঁটা যেন আনন্দবারি! বৃষ্টি শেষে আবারও রোদ। দিগন্তজুড়ে একে সাতরঙা উদ্ভাসে ফুটে ওঠে রংধনু।
শ্রাবণ বিদায় নিয়েছে। বর্ষার খেয়ালী প্রকৃতি প্রসন্ন ছিল না। প্রত্যাশিত বৃষ্টিপাত হয়নি। গতকালও বর্ষার বদলে তাপদাহ ঢেলেছে সূর্য। তা বলে দিন তো আর বসে থাকে না। ঋতু বদলায়। মনও হয় আন্দোলিত। শরৎকালের মধ্যেই যেন বাংলাদেশের হৃদয়ের স্পর্শ পাওয়া যায়। নদীর তীরে তীরে কাশফুলের শুভ্রতার প্লাবন, মাঠে মাঠে সবুজের মেলা; এত নীল আর এত সাদার একত্র সমাবেশ কেবল শরতেই দেখা মেলে এই রূপসী বাংলায়। ঋতুচক্র নানা বর্ণে-গন্ধের সমারোহে নিত্য আবর্তিত হয়ে চলে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য শহরবাসীর অন্তর আজ আর শরতের নিমন্ত্রণ অনুভব করে না। প্রতিবারই শরৎ আসে, সাজে অপরূপ সাজে। কিন্তু শহরের যান্ত্রিক জীবনে এর রূপ দেখার সময় যেন নেই অনেকেরই।
বাংলাদেশ সময়: ১২:০১:১৩ ১১৫৮ বার পঠিত