বিএনপিতে যে মারাত্মক নেতৃত্বের সংকট রয়েছে, তা আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে। গেল ১৫ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি কোনোভাবেই ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। বিভাগীয় জনসমাবেশগুলোতে নেতাকর্মীদের বিপুল উপস্থিতির পূর্বাভাস দেয়া হলেও তা সফল হচ্ছে না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সমাবেশ নিয়ে বিএনপির গর্জন যত, বর্ষণ তত নয়।
এছাড়া তারা মনে করেন, দলের প্রধান দুই নেতা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান – বড় অপরাধে দণ্ডিত। নির্বাচনী রাজনীতিতে তারা অযোগ্য বিবেচিত হয়েছেন। ফলে বিএনপির এখন আন্দোলনের দিকেই ঝোঁক বেশি। কিন্তু তাতেও তারা সফল হতে পারছেন না। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বিএনপি মূলত আন্দোলনের নামে সহিংস রাজনীতিই করছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দেশে একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি করতে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় একটি সমাবেশ করতে চাচ্ছে বিএনপি। দলটির নেতারা নিয়মিত উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। সরকার তাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দিলেও নয়াপল্টনে রাস্তা বন্ধ করে সমাবেশ করতে চাচ্ছেন তারা। এ নিয়ে চারদিকে ছড়াচ্ছে আতঙ্ক।
মিডিয়া কার্ড প্রত্যাখ্যান সাংবাদিকদের
রাজশাহীতে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশে ইস্যু করা ‘মিডিয়া কার্ডে’ দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ছবি ছিল, যা বিএনপির জন্য হিতে বিপরীত হয়েছে। মিডিয়া কার্ডে থাকা ছবি নিয়ে আপত্তি জানান সাংবাদিকরা। তারা মিডিয়া কার্ড বর্জন করেন। রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতিও দেয়া হয়।
কার্ডে মিডিয়া উপ-কমিটির সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন ও সদস্যসচিব আতিকুর রহমানের সই ছিল। গত শুক্রবার (২ ডিসেম্বর) বিকেলে রাজশাহী নগরের একটি হোটেলের সম্মেলন কক্ষে বিতরণ করা হয় এ কার্ড। রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি রফিকুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক তানজিমুল হক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, সমাবেশের সংবাদ সংগ্রহের জন্য গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে বিএনপির দেয়া মিডিয়া কার্ডে সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামিসহ কারাবন্দি এক আসামির ছবি ছাপানো হয়েছে। এ কারণে মিডিয়া কার্ডটি আরইউজের পক্ষ থেকে বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘আমরা গণমাধ্যমকর্মীরা কেউ সমাবেশস্থলে এ কার্ড গলায় ঝুঁলিয়ে বা সঙ্গে নিয়ে যাব না। সমাবেশে যদি ঢুকতে বাধা দেয়া হয়, তাহলে আমরা সমাবেশ বয়কট করব।’
দুর্নীতির দুই মামলায় সাজা পেয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দি হন খালেদা জিয়া। এরপর দুই বছরের বেশি সময় তাকে কারাগারে থাকতে হয়। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ থেকে খালেদা জিয়া গুলশানের ভাড়া বাড়িতেই অবস্থান করছেন। ওই সময় সরকারের নির্বাহী আদেশে প্রথমে ছয় মাসের জন্য শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পান খালেদা জিয়া।
‘দ্য কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর’-এর ধারা-৪০১ (১)-এ দেয়া ক্ষমতাবলে খালেদা জিয়ার দণ্ডাদেশ স্থগিত করা হয়। এরপর প্রতি ছয় মাস পরপর তার সাজা স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ছয়বার তার সাজা স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
বিএনপির ফ্লপ সমাবেশ
রাজশাহীর সমাবেশে ব্যাপক প্রচার ও প্রচারণা চালিয়েছিল বিএনপি। তারা দাবি করেছিল, সমাবেশে প্রচুর লোক হবে; লাখ লাখ মানুষ অংশ নেবে। কিন্তু তারা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। মাদরাসা মাঠে সমাবেশের আয়োজন করেছিল বিএনপি। স্থানীয়রা বলছেন, মাঠটিতে ২৫ হাজারের মতো মানুষ হলে কানায় কানায় ভরে যায়, আশপাশে রাস্তা মিলে ৫০ হাজার মানুষ লাগে পূর্ণ হতে।
কিন্তু বিএনপির সমাবেশের মাঠটি ছিল ফাঁকা। এমনকি রাজশাহীর বাইরে থেকে লোকজন এনেও তারা মাঠটি পূর্ণ করতে পারেননি। চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা, রংপুর, বরিশাল, ফরিদপুর, সিলেট, কুমিল্লার পর রাজশাহীতে গণসমাবেশ করেছে বিএনপি।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘বিএনপির সমাবেশে সাধারণ মানুষের যাওয়ার তো বাস্তবতা নেই, অংশ নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এ ধরনের আন্দোলন, সরকারর পতনের অগণতান্ত্রিক ঘোষণার সঙ্গে সাধারণ মানুষ থাকবে না - এটাই স্বাভাবিক। সেই কারণে আমি মনে করি, এই সমাবেশ ফ্লপ হয়েছে। বিএনপির কতিপয় নেতাকর্মী ছাড়া সাধারণ মানুষ সমাবেশ প্রত্যাখ্যান করেছে।’
বিএনপির রাজশাহী সমাবেশের ড্রোন থেকে তোলা একটি ছবি সামাজিকমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এতে দেখা গেছে, মাঠের বিশাল অংশ খালি পড়ে আছে। ছবিটি যখন তোলা হয়, তখন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বক্তব্য দিচ্ছিলেন।
কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলও ড্রোনভিডিও ব্যবহার করেছে। তাতেও বিএনপির জন্য আশাভঙ্গের খবরই দেখা গেছে। দলের শীর্ষ নেতারা বক্তব্য দেয়ার সময়ও মাঠের অর্ধেকটা খালি পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
ভিডিওতে দলের বিভিন্ন নেতার অনুসারীদের হাতে লাঠি দেখা গেছে। তারা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। পরে জ্যেষ্ঠ নেতাদের হস্তক্ষেপে তার সুরাহা হয়েছে।
বিএনপির চট্টগ্রামের সমাবেশ নিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেন, বিএনপি চট্টগ্রামে যে সমাবেশ করেছে, সেটির প্রস্তুতি তারা দীর্ঘ তিন মাস ধরে নিয়েছে। তারা বলেছিল, পনের লাখ মানুষের সমাগম হবে। কক্সবাজার ও টেকনাফ থেকেও তারা মানুষ এনেছেন।
তিনি বলেন, তারা পলোগ্রাউন্ড মাঠের চল্লিশ শতাংশ পেছনে রেখে মঞ্চ করেছে। কিন্তু মাঠের এক-তৃতীয়াংশও ঠিকমতো পূর্ণ হয়নি। চট্টগ্রামে জব্বারের বলি খেলায় যত মানুষ হয়, তার চেয়েও অনেক কম মানুষ হয়েছে বিএনপির সমাবেশে।
বিএনপির সমাবেশে মানুষের কম উপস্থিতি বলে দিচ্ছে দলটিতে নেতৃত্ব সংকট রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরাও সেই কথা বলছেন। কারণ এসব সমাবেশে মানুষ জড়ো করতে বিএনপি নেতারা কোটি কোটি টাকা খরচ করেছেন। তবুও তারা প্রত্যাশামতো সমাবেশ করতে পারেননি।
নেতাদের উসকানিমূলক বক্তব্য
‘১০ ডিসেম্বরের পর খালেদা জিয়ার নির্দেশে দেশ চলবে, তারেক রহমান সমাবেশে যোগ দেবেন’ বলে বিএনপির পক্ষ থেকে নিয়মিত হুমকি দেয়া হচ্ছে। বিপরীতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, বিজয়ের মাসে বিএনপি কোনো ধরনের নৈরাজ্য তৈরি করতে চাইলে সমুচিত জবাব দেয়া হবে। আওয়ামী লীগ কর্মীরাও ওইদিন রাজপথে থাকবে, ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে পাহারা দেবে বলে জানানো হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার যেহেতু বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে, সেহেতু বিএনপির উচিত নয়াপল্টনের সংকীর্ণ রাস্তা দখল করে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি সৃষ্টি না করা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বড় জমায়েত করে সরকারকে তাদের সামর্থ্য দেখিয়ে দিতে পারে। কিন্তু সাধারণ মানুষের চলাচলের রাস্তা দখল করে সমাবেশ করতে তারা জেদ ধরে বসে আছে।
গেল ১০ অক্টোবর বিএনপি নেতা শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী বলেন, ১০ ডিসেম্বর থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নির্দেশে দেশ চলবে। খুব শিগগিরই তারেক রহমান যুক্তরাজ্য থেকে দেশে আসবেন। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এখনও ষড়যন্ত্র চলছে। কোনো ষড়যন্ত্রই কাজে আসবে না। অবিলম্বে তাদের সব মামলা প্রত্যাহার ও খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে হবে।
এর আগে দলটির আরেক নেতা আমানউল্লাহ আমানও একই কথা বলেন। তিনি বলেন, আগামী ১০ ডিসেম্বর থেকে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নেতৃত্বে দেশ চলবে।
আমানের বক্তব্যকে দেশবিরোধী আখ্যায়িত করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান সময় সংবাদকে বলেন, এটা একেবারেই দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য। কারণ দেশ চলে সংবিধান অনুসারে, কারও কথায় না। কাজেই এ রকম বক্তব্য দেয়ার অর্থ হচ্ছে উসকানি দেয়া, রাজনৈতিক মাঠ গরম করা।
২০০৭ সালের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গ্রেফতারের পরের বছর চিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তি নিয়ে যুক্তরাজ্যে যান তারেক রহমান। চিকিৎসা শেষ হলেও ১৪ বছরে তিনি ফেরেননি দেশে।
এর মধ্যে বিদেশে অর্থপাচার, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা এবং বঙ্গবন্ধুকে কটূক্তির মামলায় সাজা হয়েছে তার। এর মধ্যে সর্বোচ্চ সাজা হয়েছে গ্রেনেড হামলা মামলায়। বিদেশে অবস্থানের কারণে কোনো মামলায় আপিলও করতে পারেননি তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১১:৩৯:৪৩ ২৩১ বার পঠিত