মোস্তাফিজার রহমান রংপুর প্রতিনিধি : পঞ্চগড়ের পুলিশ সুপার এসএম সিরাজুল হুদা বলেছেন, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালিয়েছে প্রশিক্ষিত একটি দল। পরিকল্পিত হামলায় গানপাউডার ও পেট্রোল ব্যবহার করা হয়। পুলিশ তাৎক্ষণিক অ্যাকশনে গেলে প্রাণহানি বাড়ত এবং সারা দেশে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ত। তিনি বলেন, দেশকে অস্থিতিশীল করতে বিশেষ স্বার্থান্বেষী মহলের উসকানিতেই হামলা হয়েছে।
পঞ্চগড় শহরে আহমদিয়াদের সালানা জলসাকে কেন্দ্র করে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার সাত দিন পর প্রেস ব্রিফিংয়ের পুলিশ সুপার এ তথ্য জানান। বৃহস্পতিবার দুপুরে নিজ অফিস কক্ষে প্রেস ব্রিফিংয়ে পুলিশ সুপার এসএম সিরাজুল আরও বলেন, সালানা জলসায় আট হাজারের বেশি আহমদিয়া সদস্য অবস্থান করেছিলেন। চার পাশ থেকে সাত-আট হাজার মানুষ হামলা চালায়। হামলার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশের ১৭০, র্যাবের ৬৪ এবং বিজিবির ৫ প্লাটুন সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। এজন্য পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল।
হামলার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৩টি মামলা হয়েছে জানিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, এর মধ্যে পঞ্চগড় সদর থানায় ১১টি ও বোদা থানায় দুটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে বিশেষ ক্ষমতা আইনে চারটি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করেছে পুলিশ। অন্য মামলাগুলো ক্ষতিগ্রস্তরা করেছেন। শতাধিক ব্যক্তিকে এজাহারভুক্ত করে ১০-১১ হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তিকে এসব মামলার আসামি করা হয়েছে। আরও মামলা প্রক্রিয়াধীন। ১৩টি মামলায় ১৬৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হামলার সঙ্গে জড়িতরা এখন আতঙ্কে থাকবে উলেখ করে তিনি আরও বলেন, সাধারণ মানুষের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমাদের কাছে ঘটনার পর্যাপ্ত ছবি, ভিডিও ও সিসিটিভি ফুটেজ আছে। এসব যাচাই-বাছাই করে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জড়িতদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। নিরপরাধ কাউকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না।
পুলিশের কঠোর তৎপরতায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব হয়েছে বলে দাবি করে তিনি বলেন, মামলায় নিরপরাধ কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না। সারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে একটি বিশেষ স্বার্থান্বেষী মহলের উসকানিতে পঞ্চগড়ে হামলা হয়েছে বলে দাবি করে পুলিশ সুপার সিরাজুল হুদা বলেন, হামলায় পুলিশ, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক সদস্য আহত হয়েছে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ট্রাফিক পুলিশ বক্স। হামলাকারীরা একজন বৃদ্ধ পুলিশ সদস্যকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করেছে। তবে বর্তমানে পঞ্চগড়ের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। প্রেস ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) এসএম শফিকুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) রাকিবুল ইসলাম এবং সদর থানার ওসি আব্দুল লতিফ মিঞাসহ জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
আহমদিয়াদের বার্ষিক সালনা জলসা বন্ধের দাবিতে ৩ মার্চ পঞ্চগড় সদর উপজেলার আহমদনগর ও বোদা উপজেলার শালশিরি গ্রামে কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। ওই দিন দুজনের মৃত্যু হয়। ১৩টি মামলায় ১৬৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার সাতজনের নাম-পরিচয় প্রকাশ করেছে পুলিশ। ফেসবুকে গুজব সৃষ্টি করে আন্দোলনে অংশগ্রহণের অভিযোগে সদর উপজেলার অমরখানা বোর্ড বাজার এলাকার সফিউল আলম স্বপন ও তেঁতুলিয়া উপজেলার দেবনগর এলাকার রাব্বী ইমন, একই উপজেলার কুমারটোল গ্রামের নাসিরউদ্দিনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা সবাই শিবির কর্মী। মাইকে হত্যার গুজব ছড়ানোর অভিযোগে সদর উপজেলার রাজনগর এলাকার যুবদল নেতা ফজলে রাব্বী ও একই উপজেলার তেলীপাড়া এলাকার মশিউর রহমান এবং আহমদিয়া সম্প্রদায়ের প্রকৌশলী জাহিদ হাসানকে হত্যার অভিযোগে পঞ্চগড় পৌর এলাকার তুলারডাঙ্গা গ্রামের মো. রাসেল ও রাজনগর খালপাড়া এলাকার ইসমাঈল হোসেন ঝানুকে গ্রেফতার করা হয়।
আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বিদ্যালয়ও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে : আহমদিয়া সম্প্রদায় অধ্যুষিত সদর উপজেলার আহমদনগরে উচ্চ বিদ্যালয় ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বিদ্যালয় দুটির আসবাবপত্রসহ দুটি গ্রামের শতাধিক শিক্ষার্থীর বই-খাতা পুড়ে গেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাসুদুল হক জানান, শ্রেণিভিত্তিক তালিকা দিলে নতুন পাঠ্যপুস্তক ও খাতা-কলম সরবরাহ করা হবে। আহমদনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জুয়েল প্রধান ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফরিদা বেগম জানান, নতুন করে পাঠ্যবই ও আসবাবপত্র সরবরাহ করা না হলে বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করা সম্ভব নয়।
এদিকে, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়ে পঞ্চগড়-১ আসনের সংসদ-সদস্য মো. মজাহারুল হক প্রধান বলেছেন, হামলার ঘটনায় চুনোপুঁটিদের ধরে লাভ নেই, মূলহোতাদের ধরতে হবে। তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তিনি বলেন, লুটতরাজ করতেই বিশেষ মহল এ কাণ্ড ঘটয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতেও এটি জঘন্য কাজ। প্রশাসন আরেকটু সতর্ক অবস্থান নিলে কিছুটা হলেও ক্ষয়ক্ষতি কম হতো। বুধবার পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন শেষে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের নেতা আহমদ তবশের চৌধুরী, মাহমুদ আহমেদ সুমন, আহমদিয়া জামে মসজিদের ইমাম সালাহ উদ্দিনসহ ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে তিনি কথা বলেন। ক্ষতিগ্রস্তদের কাছ থেকে তিনি হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের বর্ণনা শোনেন।
এ সময় জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবু তোয়াবুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিপেন চন্দ্র রায়, জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌরসভার মেয়র জাকিয়া খাতুন, ছাত্রলীগ সভাপতি আবু মো. নোমান হাসান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে শাড়ি, লুঙ্গি ও কম্বল বিতরণ করা হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৫:৪৪:৩৫ ১৭৪ বার পঠিত