গ্রীষ্ম আসতে কিছুদিন বাকি থাকলেও দিন ও রাতের তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করেছে সমান তালে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদা। দেশে এখন গড়ে বিদ্যুতের চাহিদা ১০ থেকে ১২ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু আসন্ন রমজানে এবং সেচ মৌসুমে এ চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াটে দাঁড়াবে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। পরিস্থিতি সামাল দিতে লোডশেডিংয়ের পরিকল্পনা করছে সরকার।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে এখন মোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ১৫৪টি। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। তবে প্রতিদিন এ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হয় না। গত বছরের ১৬ এপ্রিল সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ৬৫টি। এসব কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ১১ হাজার ২২৮ মেগাওয়াট। যা মোট উৎপাদনের ৪৯ শতাংশ। ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ৬৪টি। উৎপাদন ক্ষমতা ৫ হাজার ৯২৫ মেগাওয়াট। যা মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ২৬ শতাংশ। কয়লাভিত্তিক ৫ বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ২ হাজার ৬১২ মেগাওয়াট। যা মোট উৎপাদনের ১২ শতাংশ। এছাড়া নবায়নযোগ্য খাত থেকে উৎপাদিত হয় ৪৮৯ মেগাওয়াট। আমদানি করে আনা হচ্ছে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট।
২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রতি ৬ ঘণ্টায় আধা ঘণ্টা করে লোডশেডিং করা হতে পারে। অথবা ১০ ঘণ্টায় এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং করা হতে পারে। অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টা লোডশেডিং করা হবে। এভাবে লোডশেডিং করা হলে খুব একটা ভোগান্তি হবে না।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন
তবে জ্বালানি সংকটের ফলে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ অনেকটাই কমে এসেছে। গ্যাস ও ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনের পরিমাণও অর্ধেকে নেমেছে।
অপরদিকে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় কয়লা, ফার্নেস অয়েল ও গ্যাসের ওপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে সরকার।
যদিও গত বছর যখন ঘনঘন লোডশেডিংয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ‘এ বছরই শেষ। আগামী বছর এ সমস্যা আর থাকবে না।’ কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা! গত বছরের তুলনায় এবার বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। সেই সঙ্গে কমেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও আমদানি। এ অবস্থায় গতবারের তুলনায় লোডশেডিং বাড়বে বৈ কমবে না।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা ধারণা করছি, এবার গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াট হবে। গত বছর আমাদের সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল ১৪ হাজারে মেগাওয়াট। তবুও আমাদের লোডশেডিং করতে হয়েছে।
তিনি বলেন, এবারের চাহিদা পূরণ করতে বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। গ্যাস থেকে সাড়ে ১১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। কিন্তু সেটা এখন কমে গেছে। অন্যদিকে শিল্প খাতে গ্যাসের চাহিদা বেড়ে গেছে। কিছু কারখানার গ্যাস ছাড়া বিকল্প জ্বালানি নেই। ফলে শিল্প খাতে দেওয়ার পর যে পরিমাণ গ্যাস থাকবে তা দিয়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। এ জন্য জন্য পেট্রোবাংলার কাছে ১৩০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস চাওয়া হয়েছে।
ডিজেলের দাম এখন বেশি থাকায় আপাতত তা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে না। খুব বেশি প্রয়োজন হলে ডিজেলের ব্যবহার করা যেতে পারে। সবমিলিয়ে প্রায় ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। এখন সম্ভাব্য ঘাটতি থাকছে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এ ঘাটতি মেটাতে লোডশেডিংয়ের দিকে যাওয়া হতে পারে। তবে সেটা দুর্বিষহ পর্যায়ে যাবে না।
তিনি বলেন, কয়লা থেকে সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট আর ফার্নেস অয়েল থেকে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। রামপাল, পায়রা ও বরিশালের বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং বড়পুকুরিয়াসহ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে তিন হাজার ৫০০ মেগাওয়াট পাওয়া যাবে। নবায়নযোগ্য খাত থেকে পাওয়া যাবে ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। ডিজেলের দাম এখন বেশি থাকায় আপাতত তা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে না। খুব বেশি প্রয়োজন হলে ডিজেলের ব্যবহার করা যেতে পারে। সবমিলিয়ে প্রায় ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। এখন সম্ভাব্য ঘাটতি থাকছে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এ ঘাটতি মেটাতে লোডশেডিংয়ের দিকে যাওয়া হতে পারে। তবে সেটা দুর্বিষহ পর্যায়ে যাবে না।
মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রতি ৬ ঘণ্টায় আধা ঘণ্টা করে লোডশেডিং করা হতে পারে। অথবা ১০ ঘণ্টায় এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং করা হতে পারে। অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টা লোডশেডিং করা হবে।এভাবে লোডশেডিং করা হলে খুব একটা ভোগান্তি হবে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে এখন জ্বালানির সংস্থান করাই বড় চ্যালেঞ্জ। চলতি বছরের শুরু থেকেই ডলার সংকটে ছিল বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। ডলার সংকটে কয়লা আমদানি না করতে পারায় এক মাস বন্ধ রাখতে হয়েছিল রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ফলে শীত মৌসুমেও লোডশেডিংয়ের কবলে পড়তে হয়েছিল গ্রাহকদের। নিয়মিত ঋণপত্র (এলসি) খুলতে না পারায় জ্বালানি তেল আমদানি ও সরবরাহে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)।
এদিকে এলএনজি আমদানিতে ১৯৪ কোটি ডলার চেয়েছে বাংলাদেশ তৈল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। দেশে উৎপাদিত গ্যাসের জন্য বহুজাতিক কোম্পানিকে মাসে ৫ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হয় প্রতিষ্ঠানটির। কিন্তু মূলধনের অভাবে বিল পরিশোধ করতে পারছে না পেট্রোবাংলা। এছাড়া এলএনজি আমদানির শুল্ক-কর বাবদ ১২ হাজার কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে তাদের। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে বিদ্যুৎ ক্রয়-বিক্রয়ের বিল পরিশোধে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে ৪ হাজার ২১০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা চেয়েছে পিডিবি। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিয়ে রয়েছে শঙ্কা।
ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা শামসুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকার দফায় দফায় বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করেছে। মূল্যবৃদ্ধির বিনিময়ে জনগণ যেটা চায় সেটা হলো নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ। সেটাও যদি সরকার নিশ্চিত করতে না পারে তাহলে এটা তাদের ব্যর্থতা। তাই সরকারকে এখন পরিকল্পনামাফিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে জোর দিতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯:০৮:১১ ১২৯ বার পঠিত