পবিত্র রমজান মাসের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতগুলোর মধ্যে একটি হলো ইতেকাফ। ইতেকাফ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো অবস্থান করা। শরীয়তের পরিভাষায়, ইতেকাফের নিয়ত করাসহ পুরুষের জন্য এমন মসজিদে অবস্থান করা যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সহিত আদায় করার ব্যবস্থা রয়েছে। আর নারীদের জন্য ঘরের ভেতর এমন জায়গায় অবস্থান করা যেখানে নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে।
রমজান মাসকে ইবাদতের জন্য প্রতিযোগিতার মাস বলা হয়ে থাকে। রাসূল (সা.) এর আমলে রমজান মাসে সাহাবীগণ এ মাসে ইবাদতের প্রতিযোগিতা করতেন। আর এ মাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো ইতেকাফ পালন করা। ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশদিন ইতেকাফ করতেন।’ (বুখারি, মুসলিম)
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘প্রতি রমজানের শেষ দশকে রাসূল (সা.) ইতেকাফ করতেন। তবে যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন, সে বছর তিনি ২০দিন ইতেকাফে কাটান।’ (বুখারি: ১৯০৩)।
ইতেকাফের প্রকারসমূহ:
ইতেকাফ তিন প্রকার।
১) সুন্নাত ইতেকাফ: রমজানের শেষ ১০ দিনের ইতেকাফই সুন্নত। রমজানের ২১ তারিখের রাত থেকে ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা পর্যন্ত এই ইতেকাফের সময়। কারণ রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতি বছর এ দিনগুলোতে ইতেকাফ করতেন। একারণে একে সুন্নত ইতেকাফ বলা হয়। আর সুন্নাত ইতেকাফ ভঙ্গ হয়ে গেলে তা কাজা করা ওয়াজিব।
২) ওয়াজিব ইতেকাফ: মান্নতের ইতেকাফ হলো ওয়াজিব ইতেকাফ। সুরা হজের ২৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা যেন তাদের মানত পূর্ণ করে।’
৩) নফল ইতেকাফ: এ ইতেকাফ যেকোনো সময় করা যায়। এর জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় বা রোজা থাকা বাধ্যতামূলক নয়। অর্থাৎ কিছু সময়ের জন্য ইতেকাফের নিয়তে মসজিদে অবস্থান করা। যতক্ষণ মন চায় ততক্ষণ এ ইতেকাফ করা যায়।
ইতেকাফের বিধান:
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে সুরা বাকারার ১২৫ নম্বর আয়াতে বলেন,
وَ اِذۡ جَعَلۡنَا الۡبَیۡتَ مَثَابَۃً لِّلنَّاسِ وَ اَمۡنًا ؕ وَ اتَّخِذُوۡا مِنۡ مَّقَامِ اِبۡرٰهٖمَ مُصَلًّی ؕ وَ عَهِدۡنَاۤ اِلٰۤی اِبۡرٰهٖمَ وَ اِسۡمٰعِیۡلَ اَنۡ طَهِّرَا بَیۡتِیَ لِلطَّآئِفِیۡنَ وَ الۡعٰکِفِیۡنَ وَ الرُّکَّعِ السُّجُوۡدِ
অর্থ: ‘আর স্মরণ কর, যখন আমি কাবাকে মানুষের জন্য মিলনকেন্দ্র ও নিরাপদ স্থান বানালাম এবং (আদেশ দিলাম যে,) তোমরা মাকামে ইবরাহিমকে নামাজের স্থানরূপে গ্রহণ কর। আর আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম যে, ‘তোমরা আমার ঘরকে তাওয়াফকারী, ইতেকাফকারী ও রুকুকারী-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র কর।’
এ আয়াতে আল্লাহ ইতেকাফের গুরুত্বকে বুঝিয়েছেন। এ আয়াত থেকে বুঝা যায়, ইতেকাফ আল্লাহর দেয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। আল্লাহ প্রথম কাবা শরীফকে তাওয়াফ, ইতেকাফ ও নামাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন। দ্বিতীয়ত, কাবা শরীফে আগে তাওয়াফ আর পরে নামাজ পড়া হয়। তৃতীয়ত ফরজ হোক কিংবা নফল হোক কাবা শরিফের ভেতরে যে কোনো নামাজ আদায় করাই বৈধ।
ইতেকাফের আরেকটি গুরত্বপূর্ণ বিধান হলো- স্বামী-স্ত্রী ইতেকাফে বসলে মেলামেশা করতে পারবে না। এটি মহান আল্লাহর নির্দেশ। সুরা বাকারার ১৮৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَلاَ تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ تِلْكَ حُدُودُ اللّهِ فَلاَ تَقْرَبُوهَا
অর্থ: আর যতক্ষণ তোমরা ইতেকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান কর, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সঙ্গে মেলামেশা করো না। এই হলো আল্লাহ কর্তৃক বেঁধে দেয়া সীমানা। অতএব, এর কাছেও যেও না।’
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, নবীজী (সা.) রমজানের শেষ দশক ইতেকাফ করতেন।’ (বুখারি ও মুসলিম)
হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, নবীজী (সা.) ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত রমজানের শেষ দশক ইতেকাফ করতেন এবং তার স্ত্রীগণও তার পরবর্তীতে ইতেকাফ করেছেন।’ (বুখারি ও মুসলিম)
ইতেকাফের ফজিলত:
ইতেকাফের ফজিলত বর্ণনা করতে গিয়ে প্রিয়নবী (সা.) ঘোষণা দেন
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একদিন ইতেকাফ করবে আল্লাহ তায়ালা তার ও জাহান্নামের মাঝে তিন পরিখা পরিমাণ দূরত্ব সৃষ্টি করবেন; যার দূরত্ব আসমান ও জমিনের মধ্যবর্তী দূরত্বের থেকে বেশি।’ (কানযুল উম্মাল: ২৪০১৯)
ইতেকাফ পালনকারী দুই কবুল হজ ও দুই ওমরার সাওয়াব পাবেন। রাসুল (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানে দশ দিন ইতেকাফ করবে তার আমল নামায় দুইটি কবুল হজ ও দুইটি ওমরার সমতুল্য সওয়াব লিখা হবে।’ (শুআবুল ইমান: ৩৬৮১; কানযুল উম্মাল: ২৪০০৬)
রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘ইতেকাফকারী ইতেকাফের কারণে গোনাহ থেকে মুক্ত হয়ে যায় এবং সব নেকির সওয়াব অর্জন করে।’ (আল মুগনি : ৩/৪৫৫)।
অন্য এক হাদিসে এসেছে, রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মাগরিব ও এশার মধ্যবর্তী সময়ে জামাত প্রতিষ্ঠিত হয় এমন মসজিদে ইতেকাফে থাকবে, নামাজ এবং কোরআন তেলাওয়াত ছাড়া কোনো কথা বলবে না, তার জন্য বেহেশতে মহল তৈরি করা আল্লাহর দায়িত্ব হয়ে যাবে।’ (কাশফুল গুম্মাহ : ১/২১২)।
ইতেকাফের উপকারিতা:
১. পবিত্র শবে কদর পাওয়ার অন্যতম মাধ্যম ইতেকাফ। হাদিসে এসেছে-
‘রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার সাথে ইতেকাফ করেছে সে যেন শেষ দশক ইতেকাফ করে। কারণ, আমাকে লাইলাতুল কদর সম্পর্কে অবগত করা হয়েছিল (যে তা শেষ দশকের ওমুক রাতে)। এরপর তা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। সুতরাং তোমরা লাইলাতুল কদর শেষ দশকে খোঁজ কর।’ (বুখারি)
হজরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.) বলেন, তোমরা মাহে রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর তালাশ করো।’ (বোখারি : ২০১৭)।
২. ইতেকাফকারী অবসর সময়ে যদি কোনো আমল না ও করে তবুও তার দিনরাত ইবাদত হিসেবেই গণ্য হয়।
৩. ইতেকাফ করলে পাপাচার ও গোণাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকা যায়। কেননা ইতেকাফকরী মসজিদে অবস্থান করে। আর আল্লাহর ঘর মসজিদ হলো গোণাহ থেকে বেঁচে থাকার জন্য সর্বোত্তম জায়গা। এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা সুরা তওবার ১১৯ নম্বর আয়াতে বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো।’
৪. দুনিয়াবী সব ঝামেলা ও সমস্যা থেকে ইতেকাফের মাধ্যমে মুক্ত থাকা যায়।
৫. রোজার যাবতীয় হক ও আদব পরিপূর্ণভাবে আদায় করার জন্য ইতেকাফ অত্যন্ত কার্যকর।
৬. আল্লাহ তাআলা সঙ্গে মহব্বত ও ভালবাসা সৃষ্টি করার অন্যতম মাধ্যম মসজিদে ইতেকাফ করা। কারণ এসময় এক ধ্যানে আল্লাহর ইবাদত করা যায়। ফলে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সম্ভব হয়।
৭. সুরা রাদের ২১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘জেনে রাখো, আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তরসমূহ শান্তি পায়।’ মসজিদে অবস্থান করে আল্লাহ তায়ালার স্মরণে নিজেদের নিয়োজিত রাখার কারণে ইতেকাফকারী সত্যিকারের এক প্রশান্তি অর্জন করেন।
৮. ইতিকাফের ফলে বেশি বেশি নফল ইবাদতের সুযোগ পাওয়া যায়। আর হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত হয়েছে; আল্লাহ বলেন, ‘আমি যা কিছু আমার বান্দার ওপর ফরজ করেছি, তা দ্বারা কেউ আমার নিকটবর্তী হয় না। বান্দা নফল ইবাদতের দ্বারা আমার নিকটবর্তী হতে থাকবে।’ (বোখারি : ৬৫০২)। তাই ইতেকাফের সময়ে বেশি বেশি নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া সম্ভব।
৯. মাহে রমজানের শেষ দশকের ইতেকাফ সুন্নাতে মুয়াক্কাদায়ে কেফায়া। পুরো মহল্লার থেকে কয়েকজন, না পারলে কমপক্ষে একজন মানুষ ইতেকাফ আদায় করলেই সবার দায়িত্ব পালন হয়ে যায়। তবে যারা ইতেকাফে বসেন, তারা রাসুল (সা.) এর এ সুন্নাতটি অন্যের দ্বারা আদায় না করিয়ে সরাসরি নিজেরাই আদায় করলেন। (দুররে মুখতার : ২/৪৪০)।
১০. ইতেকাফকারীর মসজিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি হয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সাত শ্রেণির মানুষদের আল্লাহতায়ালা হাশরের ময়দানে আরশের নিচে ছায়া দান করবেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো, যাদের হৃদয়টা মসজিদের সঙ্গে ঝুলন্ত থাকে।’ (বোখারি : ৩২১৫)।
আরেক হাদিসে বর্ণিত আছে, কেয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা বান্দাদের ডেকে বলবেন, ‘আমার প্রতিবেশী লোকেরা কোথায়?’ তখন ফেরেশতারা বলবেন, ‘আপনার প্রতিবেশী আবার কারা?’ আল্লাহ বলবেন, ‘যারা দুনিয়াতে আমার ঘর (মসজিদ) এর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক রেখেছে এবং মসজিদ নির্মাণে ভূমিকা রেখেছে।’ (মুসনাদে আহমদ : ১০/২০৩)।
তাই মুমিন মুসলমান রোজাদারের উচিত রমজানের শেষ দশদিন ইতেকাফে অংশগ্রহণ করা। কেনানা রমজানের ইতেকাফ পালন যেমন মহান আল্লাহর নির্দেশ আবার প্রিয় নবী (সা.) একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত ইবাদতও বটে।
বাংলাদেশ সময়: ১১:৪১:১৪ ১৩৬ বার পঠিত