উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, জাতীয় নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ৬২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর।
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে তিনি বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য, সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সভাপতি, কলকাতার মেয়র, অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী এবং পূর্ববাংলার গভর্নরসহ বহু মর্যাদাশীল পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
রামপালে ট্রাকের চাপায় তিনজন নিহত
তার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিন এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন।
বাংলার বাঘ এ কে ফজলুল হক ১৮৭৩ সালে ২৬ অক্টোবর বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া ইউনিয়নের সাতুরিয়া মিঞাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার আদি পৈতৃক নিবাস পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলায়। তিনি কাজী মুহম্মদ ওয়াজেদ এবং সাইদুন্নেসা খাতুনের একমাত্র পুত্র ছিলেন।
এ কে ফজলুল হকের প্রাথমিক শিক্ষা বাড়িতেই শুরু হয়। পরে তিনি গ্রাম্য পাঠশালায় ভর্তি হয়েছিলেন। গৃহশিক্ষকদের কাছে তিনি আরবি, ফার্সি এবং বাংলা ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। ১৮৮১ সালে তিনি বরিশাল জিলা স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৮৮৬ সালে অষ্টম শ্রেণীতে তিনি বৃত্তি লাভ করেন এবং ১৮৮৯ সালে ফজলুল হক প্রবেশিকা (এসএসসি) পরীক্ষায় তৎকালীন ঢাকা বিভাগে মুসলমানদের মধ্যে প্রথম স্থান দখল করেন। ফজলুল হক তার প্রখর স্মৃতিশক্তির কারণে শিক্ষকদের খুবই স্নেহভাজন ছিলেন। প্রবেশিকা পাস করার পর উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তিনি কলকাতায় গমন করেন।
১৮৯১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফএ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৮৯৩ সালে তিনি তিনটি বিষয়ে অনার্সসহ প্রথম শ্রেণীতে বিএ পাস করেন। বিএ পাস করার পর এমএ ক্লাসে প্রথমে ভর্তি হয়েছিলেন ইংরেজি ভাষায়। পরীক্ষার মাত্র ছয় মাস আগে তাকে এক বন্ধু ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন যে, মুসলমান ছাত্ররা অঙ্ক নিয়ে পড়ে না, কারণ তারা মেধাবী নয়। এই কথা শুনে এ কে ফজলুল হকের জেদ চড়ে যায়। তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে, অঙ্কশাস্ত্রেই পরীক্ষা দেবেন। এরপর, মাত্র ছয় মাস অঙ্ক পড়েই তিনি প্রথম শ্রেণী লাভ করেন।
১৮৯৭ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বিএল পাস করে স্যার আশুতোষ মুখার্জির শিক্ষানবিস হিসেবে কলকাতা হাইকোর্টে নিজের নাম তালিকাভুক্ত করেন এ কে ফজলুল হক। দু’বছর শিক্ষানবিস হিসেবে কাজ করার পর ১৯০০ সালে তিনি সরাসরি আইন ব্যবসা শুরু করেন। পিতার মৃত্যুর পর ১৯০১ সালে তিনি বরিশালে ফিরে আসেন এবং বরিশাল আদালতে যোগদান করেন। ১৯০৩-১৯০৪ সালে বরিশাল বার অ্যাসোসিয়েশনের সহকারী সম্পাদক পদে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন।
১৯১৩ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে এ কে ফজলুল হক বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯১৫ সালে আবার ঢাকা বিভাগ থেকে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯১৩ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত তিনি এ পরিষদের সভায় মোট ১৪৮ বার বক্তৃতা করেন। ১৪৮ বার বক্তৃতার ভেতর ১২৮ বার তিনি দাঁড়িয়েছিলেন মুসলমানদের শিক্ষা সম্পর্কে বক্তৃতা দেয়ার জন্য। তার অদম্য চেষ্টার ফলে ১৯১৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কারমাইকেল ও টেইলার হোস্টেল স্থাপন করা হয়েছিল। তৎকালীন শিক্ষা বিভাগের ডিপিআই কর্নেল সাহেব তখন ফজলুল হকের শিক্ষাবিষয়ক উদ্যোগের প্রশংসা করে তাকে বাংলার ‘বেন্থাম’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ নিয়ে বাংলার জনগণ বিভক্ত হয়ে পড়লে, নবাব স্যার সলিমুল্লাহ উপলব্ধি করেন মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একটি সংগঠন দরকার। এই চিন্তা থেকেই ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর নবাব সলিমুল্লাহ ঢাকায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্স আহবান করেন। এই সম্মেলনে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সভাপতি ছিলেন নবাব সলিমুল্লাহ নিজে এবং যুগ্মসচিব হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন নবাব ভিকারুল মুলক এবং আবুল কাশেম ফজলুল হক। সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকার আহসান মঞ্জিলে। এই কনফারেন্সে নবাব সলিমুল্লাহ নিখিল ভারত মুসলিম লীগ নামে রাজনৈতিক দল গঠনের প্রস্তাব পেশ করেন ও সেই প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। অবশেষে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের সূত্রপাত ঘটে।
১৯২২ সালে মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলে এ কে ফজলুল হক খুলনা উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং নির্বাচিত হন। ১৯২৪ সালে খুলনা অঞ্চল থকে তিনি আবার আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং এ সময় বাংলার গভর্নর ছিলেন লিটন, তিনি ফজলুল হককে বাংলার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিয়োগ করেন।
১৯২৪ সালে শিক্ষামন্ত্রীর পদে ইস্তফা দেয়ার পর থেকে আবুল কাশেম ফজলুল হক সম্পূর্ণরূপে জড়িয়ে পড়েছিলেন কৃষকদের রাজনীতি নিয়ে। তিনি ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এ কে ফজলুল হক বহু কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। শিক্ষা ক্ষেত্রেই জোর দিয়েছিলেন বেশি। তার আমলে দরিদ্র কৃষকের ওপরে কর ধার্য না করে সারা বাংলায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করা হয়।
১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল শুক্রবার সকাল ১০টা ২০ মিনিটে এ কে ফজলুল হক ৮৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। ২৮ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত তার লাশ ঢাকার টিকাটুলি এলাকায় তার ২৭ কে এম দাস লেনের বাসায় রাখা হয়। সেদিন সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে ঢাকার পল্টন ময়দানে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। অবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তাকে সমাহিত করা হয়। একই স্থানে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও খাজা নাজিমুদ্দিনের কবর রয়েছে। তাদের তিনজনের সমাধিস্থলই ঐতিহাসিক তিন নেতার মাজার নামে পরিচিত।
বাংলাদেশ সময়: ১১:২১:০২ ৮১ বার পঠিত