রাস্তায় শরীরে ধাক্কা নিয়ে কথা কাটাকাটি। এরপর পথচারিবেশে কয়েকজন মিলে মারধর। একপর্যায়ে চোখে আঙুল দিয়ে গুল লাগিয়ে শত শত মানুষের সামনে টেনেহেঁচড়ে ব্যাগভর্তি টাকা ছিনতাই। সম্প্রতি রাজধানীর বংশালে দিনেদুপুরে এক ভুক্তোভোগী ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৬০ লাখ টাকাসহ ব্যাগ ছিনতাইয়ের এমন অভিনব ঘটনাটি ঘটে।
এ ছিনতাইকারী দলের সরদারসহ ৩ জনকে অবশ্য গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিএমপি) লালবাগ বিভাগ। গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন: মূল পরিকল্পনাকারী খোকন দাস ওরফে বাইল্যা খোকন, মূল অপারেশনাল সংগঠক রেজাউল করিম এবং ভিকটিমের গতিবিধি পর্যবেক্ষণকারী দলের কামাল হোসেন। গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে নগদ ১০ লাখ টাকার মতো উদ্ধার করা হয়।
বুধবার (২৯ মে) দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডের ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান এসব তথ্য জানান।
মশিউর রহমান বলেন, যারা বড় অঙ্কের নগদ লেনদেন করতো, তাদের টার্গেট করে ছিনতাই করতো চক্রটি। বংশালের ঘটনায়ও আগে থেকেই টার্গেট করা হয়। টাকা নিয়ে রাস্তায় বের হলেই ধাক্কা দেয় একজন। পরে এর জের ধরে চক্রের ১০ থেকে ১৫ জন ঘিরে ধরে ছিনিয়ে নেয় ব্যাগভর্তি ৬০ লাখ টাকা।
এ চক্রের সবাই নেশাগ্রস্ত ও জুয়াড়ি বলে মন্তব্য করে ডিবি কর্মকর্তা বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই দিনেদুপুরে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ছিনতাই করে আসছিল ধাক্কা পার্টির এ তিন সদস্য। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি টার্গেট করা হতো অবৈধ হুন্ডি কারবারিদেরও।
তিনি বলেন, পুরোনো ঢাকার এ এলাকাগুলোতে প্রতিদিন শত শত কোটি টাকার বৈধ লেনদেনের পাশাপাশি অনেকেই হুন্ডির মাধ্যমে টাকা লেনদেন করে থাকেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ছিনতাইকারী দলের সদস্যরা ওত পেতে থাকে হুন্ডি কারবারিদের টাকা ছিনতাই করার জন্য।
মশিউর রহমান বলেন, হুন্ডিতে টাকা লেনদেন করা আইনসিদ্ধ না। সে কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা অধিকাংশ সময় বিষয়টি পুলিশ বা আদালতকে অবগত করে না। হুন্ডি কারবারিদের এ দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে ডাকাত বা ছিনতাইকারীরা এমন অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকে। ছিনতাইকারীদের এ অপতৎপরতায় কখনো কখনো বৈধ ব্যবসায়ীরাও ক্ষতির সম্মুখীন হন।
তিনি বলেন, ছিনতাইয়ের এ ঘটনার মূল মাস্টারমাইন্ড বাইল্যা খোকন পুরোনো ঢাকায় বসবাস করে। দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় থেকে কোন ব্যবসায়ী কীভাবে টাকা লেনদেন করে — এ সম্পর্কে ভালো করে জানে। অপারেশনাল কমান্ডার রেজাউল করিম একসময় পুরোনো ঢাকাতেই ব্যবসা করতো। খুলনা, বরিশাল, চাঁদপুর, মিরপুর ও ময়মনসিংহ থেকে সমমনাদের ঢাকায় এনে টার্গেট করা ব্যক্তিকে নিরস্ত্র কায়দায় কিল ঘুষিতে রক্তাক্ত করে চোখে গুল লাগিয়ে ছিনতাই করে।
মশিউর রহমান আরও বলেন, ছিনতাই কাজে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করার জন্য তারা কম দামের বাটন ফোনে নিবন্ধনহীন সিম লাগিয়ে যোগাযোগ করে। ঘটনার পর মোবাইল ও সিম ভেঙে নদীতে ফেলে দিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পালিয়ে যায়।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মশিউর রহমান বলেন, মা বুলিয়ান অ্যান্ড সিলভার জুয়েলার্সের ম্যানেজারের নির্দেশে কর্মচারী মহিউদ্দিন গত মাসের ২৬ এপ্রিল কদমতলী খেজুরের গলিতে অবস্থিত মসলা এন্টারপ্রাইজের কাছাকাছি আড়ত থেকে ৬০ লাখ টাকা একটি নীল রংয়ের স্কুলব্যাগে ঢুকিয়ে তাঁতি বাজারের উদ্দেশে পায়ে হেঁটে রওনা দেন। বিকেল অনুমানিক ৪টার দিকে ইসলামপুরের নবনারায়ণ লেনের প্রবেশ মুখে পৌঁছামাত্র এক দুষ্কৃতকারী ভুক্তোভোগীকে ধাক্কা দিয়ে উল্টো ধাক্কা দেয়ার অভিযোগ করে।
তিনি বলেন, টাকা বহনকারী মহিউদ্দিন ‘সরি’ বলে ক্ষমা চেয়ে চলে যেতে চাইলে আশপাশে ওত পেতে থাকা আরো ১০-১৫ জন দুষ্কৃতকারী তাকে ধাক্কা দেয়ার অভিযোগ তুলে প্রচণ্ড কিল ও ঘুষি মারতে থাকে। একপর্যায়ে তার চোখে আঙুল দিয়ে গুল লাগিয়ে দেয় এবং ঢাকা ভর্তি ব্যাগটি টেনেহেঁচড়ে ছিনতাই করে নিয়ে যায়।
মশিউর রহমান বলেন, এ ঘটনায় ২৭ এপ্রিল জুয়েলার্সের মালিক আকিদুল ইসলামের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে থানায় ডাকাতির ধারায় মামলা রুজু হয়। পরবর্তীতে আশপাশের শত শত সিসি ক্যামেরা বিশ্লেষণ, ডিজিটাল এভিডেন্স কালেকশন করে থানা পুলিশের পাশাপাশি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ছায়া তদন্ত শুরু করে।
তিনি বলেন, এক পর্যায়ে থানা পুলিশ এবং ডিবি পুলিশের তদন্তে ডাকাতির এ মামলার প্ল্যানার ও এক্সিকিউটরদের নাম, পরিচয় শনাক্ত হয়। শনাক্ত করা আসামিদের অবস্থান নিশ্চিত হয়ে গত ২৫ মে দিন ও রাতে ডিবি লালবাগ বিভাগের কোতোয়ালি টিমের নেতৃত্বে একাধিক টিম চট্টগ্রাম এবং খুলনায় ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে ডাকাতির ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী খোকন দাস ওরফে বাইল্যা খোকন, মূল অপারেশনাল সংগঠক রেজাউল করিম এবং ভিকটিমের গতিবিধি পর্যবেক্ষণকারী দলের কামাল হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়।
মশিউর রহমান বলেন, গ্রেফতারকালে তাদের কাছ থেকে ডাকাতি করা নগদ সাড়ে নয় লক্ষ টাকা উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতার এড়ানোর জন্য অতি সতর্ক এই ডাকাত চক্রের সদস্যদের কাছ থেকে কোন মোবাইল উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। গ্রেফতার করা ডাকাতদের বিরুদ্ধে ডাকাতি এবং ছিনতাই বিষয়ক একাধিক মামলার সন্ধান পাওয়া গেছে।
তিনি বলেন, এরই মধ্যে পূর্ব কোতোয়ালি থানা পুলিশ ধাক্কা পার্টির আরও দুই সদস্য বাবু এবং শাহ আলমকে গ্রেফতার করেছে। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
বাংলাদেশ সময়: ১৫:৩৬:০৮ ৬৮ বার পঠিত