মাদারীপুরে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে গ্রাম আদালত। গেল এক বছরে গ্রাম আদালতে মামলা দেওয়ানি ও ফৌজদারি ১১২৯টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। আইনজীবী নিয়োগ ছাড়াই অভিযোগের দ্রুত সমাধান পাওয়ায় খুশি উভয়পক্ষই। এতে এলাকার বড় বড় অপরাধ হ্রাস পাচ্ছে বলে দাবি ইউপি চেয়ারম্যানদের।
সরেজমিনে কথা হয় মাদারীপুর সদর উপজেলার ঘটমাঝি গ্রামের বাসিন্দা মাকসুদা বেগমের সঙ্গে; তিনি জানান, প্রতিবেশী সাহেব আলী খালাসীকে এক বছর আগে ২৫ হাজার টাকা ধার দেন। কিন্তু কিছুতেই পাওনা টাকা আদায় করতে পারেননি তিনি। এলাকার অনেককেই জানালেও মেলেনি কোনো সুরাহা। শেষমেশ গত ২২ ডিসেম্বর গ্রাম আদালতে অভিযোগ দেন মাকসুদা। পরে গ্রাম পুলিশের মাধ্যমে সাহেব আলী খালাসীকে ডাকা হয়।
তিনি আরও জানান, গত ৪ জানুয়ারি ইউপি চেয়ারম্যানকে প্রধান করে ৫ সদস্য নিয়ে বসে গ্রাম আদালত। ঘণ্টাব্যাপী চলে উভয়পক্ষের শুনানি। সাক্ষ্যপ্রমাণ শেষে দ্রুত মাকসুদার পাওনা টাকা প্রদানের নির্দেশ দেন গ্রাম আদালত। মুহূর্তেই সংগ্রহ করে ৫ হাজার টাকা ও এক সপ্তাহের মধ্যে ২০ টাকা দেয়া নির্দেশ দেয়া হয়। যা হয়েছে বাস্তবায়নও।
মাকসুদার মত শত শত মানুষ হাতের কাছেই পাচ্ছেন গ্রাম আদালতের সুবিধা। কোনো প্রকার হয়রানী ও ভোগান্তি ছাড়াই দ্রুত সেবা পাওয়ায় খুশি উভয়পক্ষই।
সূত্র জানায়, জেলার ৫৯টি মধ্যে ৪৭টিতে ইউনিয়ন পরিষদে রয়েছে গ্রাম আদালতের এজলাস। হিসাব সহকারী রয়েছে ৫৫টি ইউনিয়নে। গ্রাম আদালত যেখানে মাত্র ১০টার বিনিময়ে এক একটি অভিযোগ দেয়া হয়। আর ৬০ দিনের মধ্যেই এর সমাধান। তাই তো বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই গ্রাম আদালতের কার্যক্রম।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্র জানায়, গ্রাম আদালতে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেওয়ানী মামলার ৪২১টি অভিযোগের মধ্যে নিষ্পত্তি হয় ৪১৯টি। দুটি মামলা এখনো চলমান। নিষ্পত্তি মামলা থেকে জরিমানা অর্থ আদায় করা হয় এক কোটি ৬১ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ টাকা। অপরদিকে ৭১৭টি ফৌজদারি মামলার অভিযোগ পড়ে গ্রাম আদালতে। নিষ্পত্তি হয় ৭১০টি মামলা, আর অপেক্ষমাণ ফৌজদারি মামলার সংখ্যা ৭টি। ফৌজদারি মামলার জরিমানা অর্থ আদায় করা হয়েছে ছয় লাখ ২১ হাজার ৮০০ টাকা।
তথ্য বলছে, দেওয়ানী ও ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে গ্রাম আদালতে। আর মিথ্যা অভিযোগ প্রমাণিত হলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার বিধি।
ইউপি চেয়ারম্যান ও বিচারকগণ জানান, গ্রাম আদালতে এলাকার সমস্যার নিষ্পত্তি হওয়ায় কমেছে বড় বড় অপরাধের সংখ্যা। ইউনিয়নের মানুষদের গ্রাম আদালতমুখী করতে নানান কার্যক্রমের কথা জানান স্থানীয় সরকার বিভাগ।
গ্রাম আদালত সূত্র বলছে, গ্রাম আদালতে যেসব অভিযোগ দায়ের করা হয় এরমধ্যে রয়েছে স্থাবর সম্পত্তি দখল থেকে উদ্ধার, অস্থাবর সম্পত্তি উদ্ধার বা তার মূল্য আদায়, কোনো অস্থাবর সম্পত্তি জবর দখল বা ক্ষতি করার জন্যে ক্ষতিপূরণ আদায়, গবাদিপশু অনধিকার প্রবেশের কারণে ক্ষতিপূরণ, কৃষি শ্রমিকদের পরিশোধযোগ্য মজুরি ও ক্ষতিপূরণ আদায়, স্ত্রী কর্তৃক বকেয়া ভরণপোষণ আদায়, পারিবারিক সমস্যা, পাওনা টাকা আদায়, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ও ইভটিজিং প্রতিরোধ এবং আদালতে দায়ের করা মামলার তদন্ত ও সমাধানের নির্দেশ।
ভুক্তভোগী মাকসুদা বেগম বলেন, ‘আমি ২৫ হাজার টাকা ধার দিয়ে এক বছর ঘুরেছি। পরে গ্রাম আদালতে অভিযোগ দায়ের করার এক মাসের মধ্যেই পুরো টাকা হাতে পেয়েছি। এতে খুশি। এই টাকা আদায় করতেও তেমন ভোগান্তি পোহাতে হয়নি। হয়রানী ও অর্থের অপচয়ও হয়নি।’
সাহেব আলী খালাসী বলেন, ‘বিপদে পড়ে আমি ২৫ হাজার টাকা নিয়েছিলাম। পরিবার চালাতে কষ্ট হয় তাই ধার নিয়েও সময় মত টাকা পরিশোধ করতে পারিনি। পরে গ্রাম আদালতের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করেছি। এতে কোনো উকিল বা মোহরীকে টাকা দিতে হয়নি।’
কালকিনির সাহেবরামপুর ইউনিয়নের ক্ষুদ্রচর গ্রামের সবুর মোল্লার স্ত্রীর রিনা বেগম বলেন, ‘আমি পাশের গ্রাম আন্ডারচরের জাহাঙ্গীর বেপারীকে ৫ হাজার টাকা ধার দিয়েছিলাম। অনেকবার পাওনা টাকা ফেরত দেব বলেও দেইনি। পরে গ্রাম আদালতে অভিযোগ দিলে এক সপ্তাহের মধ্যে টাকা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। আমি এই পদক্ষেপে খুশি।’
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রজেক্ট-এর আওতাধীন ওয়েব ফাউন্ডেশন নামে বেসরকারি এনজিও’র প্রতিনিধি নাসির উদ্দিন লিটন বলেন, ‘আমরা গ্রাম আদালতকে টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিচ্ছি। এই আদালতে দায়ের করা নথি ঠিক আছে কিনা, এর কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কিনা, এগুলো আমরা যাছাই-বাছাই করি। কোনো ত্রুটি পেলে দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করা হয়।’
মাদারীপুর সদর উপজেলার ঘটমাঝি ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘তৃণমূল পর্যায়ের গরিব মানুষ সাধারণ এই গ্রাম আদালতে আসেন। এখানে বিচার কাজ স্বচ্ছ ও সঠিক হয়। এখানে সাক্ষী, বিচারকমণ্ডলী বা এর সঙ্গে যারা জড়িত কাউকেই এর ফি দেয়া লাগে না। বিনামূল্যে সবাই সেবা পাচ্ছেন। বাড়ির কাছে অভিযোগ দিলে দ্রুত সমাধান পাওয়ায় দারুণ খুশি তারা।’
মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার সাহেবরামপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহিম বলেন, ‘সাধারণ মানুষ গ্রাম আদালতের সুবিধা পাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। অভিযোগ দিলেই দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে। এসব মামলার আপিলও তেমন হয় না। অভিযোগকারী ও বাদীপক্ষ দুজনেই খুশি থাকেন। কারণ উভয়পক্ষের দুজন করে ও ইউপি চেয়ারম্যানসহ মোট ৫ জনের সদস্য মিলে এই গ্রাম আদালতে দায়ের করা মামলার রায় বা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নেয়া হয়।’
মাদারীপুর সদর উপজেলার ঘটমাঝি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট বাবুল আখতার বলেন, ‘গ্রাম আদালতে ইউনিয়নের মানুষদের সমস্যার সমাধান হওয়াই দ্রুত সুবিধা ভোগ করতে পারছেন তারা। কোনো প্রকার হয়রানী হচ্ছে না। সেইসঙ্গে রোধ হচ্ছে অর্থের অপচয় ও সময়ও। এলাকার নানামুখী সমস্যার সমাধান হওয়ায় বড় বড় অপরাধ প্রবণতাও কমে যাচ্ছে।’
স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মুহাম্মদ হাবিবুল আলম বলেন, ‘গ্রাম আদালতে মাত্র ১০ টাকা দিয়েই একটি অভিযোগ দিতে পারেন ভুক্তভোগী। বলতে গেলে বাড়ির কাছে বসেই অভিযোগ দিয়ে দ্রুত সমস্যার সমাধান পাচ্ছেন। সাধারণ মানুষকে তাদের সমস্যা নিয়ে এই গ্রাম আদালতমুখী করতে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ভালো ফলও পাওয়া যাচ্ছে।’
বাংলাদেশ সময়: ১১:১৫:৪১ ১১ বার পঠিত